মৃত্যুফাঁদ লেভেল ক্রসিং ॥ রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রেলওয়ের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ। সারাদেশে রেলপথে মোট ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টি ক্রসিংয়ের গেটম্যান নেই। গত প্রায় ৩ বছরে সারাদেশে রেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার মানুষ মারা গেছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে ঘটে। রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশই অরক্ষিত। আর এসব ক্রসিংয়ে প্রায়ই ঝরছে সাধারণ মানুষের প্রাণ।
তবে দুর্ঘটনা ঘটলেই ঢাক ঢোল পিটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ আলোর মুখ দেখে না। এ ছাড়াও গত ৬ মাসে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে অন্তত ১৫ বার ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার গাজীপুরের টঙ্গী রেলওয়ে জংশন এলাকায় মালবাহী ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে ওই ট্রেনটির বগি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। দুপুর দেড়টায় ঢাকা থেকে উদ্ধার কর্মী ও রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটি লাইন থেকে সরিয়ে নেয়ার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়। বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন। এতে দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী। অধিকাংশ রেলপথ বহু বছরের পুরোনো, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না হওয়ার কারণেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হওয়ার কারণে ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে প্রায়শই। এ ছাড়া অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক, তার ওপরে রেলওয়ের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে বছরের পর বছর ধরে রেল দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু কার্যকর কোন প্রতিকার নেই। রেলওয়ে ও রেল পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
একটি জীবন কেবল একজন মানুষের একক জীবন নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে তখন অন্য জীবনেও যন্ত্রণা নেমে আসে। প্রতিনিয়ত সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। একের পর এক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য পরিবার অভিভাবকহারা হচ্ছে। অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণেও রেল দুর্ঘটনা ঘটছে। কখনও বাসের সঙ্গে, কখনও মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে এসব প্রাণহানি ঘটে। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে নেই। বিগত এক যুগে রেলওয়েতে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা রোধকল্পে তেমন কোন বড় অঙ্কের অর্থের প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখা যায় না। যে কারণে একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আর একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস টাঙ্গিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারও ভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন দায়ী ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঢাক ঢোল পিটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। একের পর এক রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
গত রবিবার বিকেলে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মোঃ ইউসুফ (৩৩) নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। খিলগাঁও রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া হতভাগ্য ইউসুফের মতো অনেকেই মারা যাচ্ছেন রেলওয়ে ক্রসিংয়ে। সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেত গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাইকারি সবজি বাজার। বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলার রেলক্রসিং পার করছেন তাদের অনেকেই। রাজধানীর শ্যাওড়াবাজার, আশকোনা, মগবাজার, এফডিসি মোড়, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী রেলক্রসিং ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল- মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও নির্বিকার পার হয়ে যান তারা। শ্যাওড়া রেলক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক গেটম্যানরা সতর্কীকরণ সাইরেন বাজালেও তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারও। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। এর মধ্যে কোনটিতে নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল বার। কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে। কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পরই ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছে মানুষ।
চলতি মাসের ৫ তারিখে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা রেল স্টেশন এলাকায় ট্রেনের হুইসেলের মধ্যেই লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছিলেন মাইক্রোবাসচালক। ট্রেনের হুইসেল বাজছিল। তাতে কান দেননি মাইক্রোবাসের চালক। হুইসেলের মধ্যেই লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার একপর্যায়ে রেললাইনের একটি অংশে মাইক্রোবাসের চাকা আটকে যায়। এরপর চোখের পলকেই ঘটে দুর্ঘটনাটি। বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসকে ঠেলে আধা কিলোমিটার নিয়ে গেল ট্রেনটি। এতে নিহত হন ২ জন। অন্য যাত্রীরা বেঁচে গেলেও দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রেলওয়ে পুলিশ। সিলেট রেলস্টেশন থেকে জানানো হয়, ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ভাটেরা পেরিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল। ভাটেরার কাছে হোসেনপুর নামের জায়গায় রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনার পর সিলেটের পথে রেল যোগাযোগ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও দুই ঘণ্টা পর তা আবার সচল হয়।
হবিগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়েছেন রেল কর্মচারী। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেট চট্টগ্রাম রেললাইনের মাধবপুর উপজেলার ইটখোলা রেলস্টেশনের অদূরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত এরশাদ আলী উপজেলার গুলাহরা গ্রামের তাজু মিয়ার ছেলে। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে নিহত এরশাদ আলী (২৮) রেল কর্মচারী।
নরসিংদীতে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি মারা গেছেন। গত ২৯ আগস্ট নরসিংদী সদর উপজেলার হাজীপুরে আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে হাজীপুর ইউনিয়নের বাদুয়ারচর রেলগেট সংলগ্ন স্থান থেকে তার লাশ উদ্ধার করে নরসিংদী রেলওয়ে ফাঁড়ির পুলিশ। নরসিংদী সদর উপজেলার বাদুয়ারচর রেলগেটের আনুমানিক ১০০ গজ দূরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তার নাম-পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন জানান, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিলেটের উদ্দেশে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাদুয়ারচর রেলগেট এলাকা অতিক্রম করার সময় ট্রেনটির নিচে কাটা পড়েন ওই ব্যক্তি। এতে তার বাঁ পা ও ডান হাতের আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মাথা থেঁতলে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে নরসিংদী রেলওয়ে ফাঁড়ির পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তার লাশ উদ্ধার করে।
যেসব কারণে রেলওয়ের দুর্ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনে শুনে রেললাইন দিয়ে হাঁটা। ঘনবসতি এলাকা দিয়ে ট্রেন চলাচলের সময় ট্রেনের হুইসেল শুনতে না পাওয়া। আঁকাবাঁকা পথে ট্রেন দেখতে না পাওয়া। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা। নেশাগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে চলাচল অন্যতম। অরক্ষিত রেল ক্রসিং আর অসচেতনতায় ঢাকাসহ সারাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনের নিচে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। আবার কেউ হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ট্রেনে কাটা পড়ছেন। অসতর্কতাবশত হাঁটতে গিয়ে স্লিপারে পা পিছলে নিহতের ঘটনাও ঘটছে। সময় বাঁচানোর নামে জীবন বাজি রাখতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছেন। এভাবেও অনেকের প্রাণ গেছে।
রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগে ছোট-বড় সব মিলে প্রায় সাড়ে আট হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার পর ৮ হাজার তদন্ত কমিটি হয়েছে। সব কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু ৯০ ভাগ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রায় অসম্ভব। কেন না ঘটনার মূলে যারা বসে আছে, তারা সবাই হয় স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয়ভাবে প্রভাবশালী না হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এ জন্য তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়লেও বাস্তবায়ন রিপোর্ট আলোর মুখ দেখতে পারে না। রেলের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যাত্রী ভোগান্তি কিংবা দুর্ঘটনা তো কমেইনি বরং অভিযোগ অন্তহীন। রেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনভাবেই যেন মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। এই রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। রেল আর সড়কের এই সংযোগস্থলকেই লেভেল ক্রসিং বলা হয়। দেশে কম-বেশি লেভেল ক্রসিং আছে আড়াই হাজার। এগুলোকে বৈধ-অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড)-এভাবে শ্রেণীবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সঙ্কেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা রেলক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত।
বর্তমানে রেলে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে প্রকল্প আছে মাত্র ১০০ কোটি টাকার। প্রকল্পটির মেয়াদও শেষ। ক্রসিংয়ে পাহারাদার হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন।
রেলের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে রেলক্রসিংয়ে যানবাহন চাপা পড়ে প্রাণহানির দায় তাদের নয়। কারণ বেশির ভাগ সংস্থা সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেয়নি। অথচ রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করা বৈধ রেলক্রসিংয়ের ৬১.৫৮ শতাংশই অরক্ষিত। রেলওয়ে ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ প্রায়শই সংরক্ষণ করে না। রেলে এ পর্যন্ত যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে এবং চলমান যে বরাদ্দ আছে, এর ১ শতাংশের কম বিনিয়োগ করলেও রেলপথ নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের চাহিদার প্রয়োজনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা সড়ক নির্মাণ করেছে। ফলে রেলপথ সুরক্ষার লক্ষ্যে এই খাতে বিনিয়োগ হতেই পারে। কিন্তু রেলের কর্মকর্তাদের এসব প্রকল্পের দিকে মনোযোগ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেছেন, প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোন লেভেল ক্রসিং রাখার অর্থই হলো এখানে প্রাণ ঝরবে। এটা জেনেও যদি কেউ সুরক্ষার ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তো বলতে হবে, মানুষের মৃত্যুতে তাদের মাথাব্যথা নেই। সড়ক ও রেল দুটিই জনগণের জন্য এবং তাদের টাকায় নির্মাণ করা হয়। ফলে সুরক্ষা তাদের প্রাপ্য। আর রেল যদি মনে করে, অবৈধ ক্রসিংয়ে বিনিয়োগ করবে না, তাহলে বন্ধ করে দিক। কম খরচেই লেভেল ক্রসিংয়ের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারের দফতরগুলো বিপুল ব্যয় আর অবকাঠামোর প্রকল্পে বেশি জোর দেয়। এ কারণে রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং বা সিগন্যাল ব্যবস্থা অরক্ষিত থেকে যাওয়ায় দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে।
ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা : রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দেশের রেলপথে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া যেন নিত্যদিনের ঘটনা। ট্রেনের গতি বাড়লে অথবা কোন ক্ষেত্রে সামান্য গতিতে এমন ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ রেলপথ বহু বছরের পুরোনো, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না হওয়ার কারণেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এসব ঘটনার মূল কারণই হচ্ছে জরাজীর্ণ রেলপথ-এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তাদের অভিযোগ, লাইন রক্ষণাবেক্ষণে কারও যেন নজরই নেই। লোক দেখানো সংস্কারের আড়ালে রেলের কালোবিড়াল আরও মোটাতাজা হচ্ছে। সংস্কারে প্রতিবছর বরাদ্দ থাকলেও পরিস্থিতির কোন উন্নয়ন হচ্ছে না। লকডাউনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় রেলপথ ফাঁকা ছিল। কিন্তু তখনও লাইন সংস্কার করা হয়নি। গত ৬ মাসে অন্তত ১৫টি ট্রেল লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-সিলেট রেল লাইনে। রেল লাইনের গুরুত্বপূর্ণ ‘পয়েন্ট সেট’ ভেঙ্গে যাওয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন রক্ষা পেয়েছে। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া লাইন আর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতুর কারণে জরাজীর্ণ এলাকাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সংস্কারহীন রেলপথ। এ ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে। নিশ্চয় রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে-মজবুত লাইনে লাইনচ্যুত হওয়ার কথা নয়। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। চলমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরাতন ট্র্যাক পুনর্বাসনে জোর দেয়া হচ্ছে। জরাজীর্ণ রেলপথে ক্লিপ, নাটবল্টু, হুক, ফিশপ্লেটসহ পাথর আছে কিনা-তা নিশ্চিত করা হবে। প্রতিবছরই বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা আর লাইনচ্যুতির ঘটনায় উন্নয়নের যথাযথ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের বিশেষজ্ঞদের মতে, লাইনচ্যুত যেন নিত্য ঘটনা। রেলে নতুন রেলপথ কিংবা ইঞ্জিন-কোচ কেনার প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিন্তু চলমান রেলপথ সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণে কোন নজর নেই। এসব দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলপথ ছেড়ে যেসব কর্মকর্তা-নতুন প্রকল্প গ্রহণে দৌড়াচ্ছে তাদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। গত এক যুগে বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে কিনা কে দেখবে? রেলপথ নিরাপদ না হলে কোন উন্নয়নেরই সুফল আসবে না। বারবার ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় ইঞ্জিন-কোচ ও রেলপথের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যাত্রীদের দুর্ভোগের সঙ্গে বাড়ে সিডিউল বিপর্যয়ও। ট্রেনের যাত্রা বাতিলসহ বিক্রি হওয়া টিকেট সমমূল্যে ফেরত দিতে হয়। গত ১২ আগষ্ট ভৈরব, গাজীপুরে তিনটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। ১৪ আগস্ট দিনাজপুর-পার্বতীপুর লাইনের কাঞ্চন মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকট শব্দে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে গত সপ্তাহে আরও তিনবার লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে। ২০ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি রেলওয়ে এলাকায় ‘পয়েন্ট সেট’ ভাঙ্গা ছিল। ওই সময় এলাকাবাসীর বুদ্ধিমত্তায় একটি যাত্রীবাহী ট্রেন দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গত মঙ্গলবার গাজীপুরের টঙ্গী রেলওয়ে জংশন এলাকায় মালবাহী ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত সাত বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার মূলত তিনটি বিশেষ কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মানুষের ভুল; দ্বিতীয়ত, কারিগরি ত্রুটি এবং তৃতীয় কারণটি হচ্ছে জরাজীর্ণ লাইনের কারণে লাইনচ্যুতির ঘটনা। বড় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মানুষের ভুল। অন্যদিকে কারিগরি ত্রুটির মধ্যে আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন-কোচের ত্রুটিই বড়। রেল দুর্ঘটনাগুলোর ৯৫ শতাংশই ঘটে লাইনচ্যুতির জন্য। গত এক যুগে রেলে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ৪৩টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু চলমান রেলপথ উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন হয়নি। ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে যাওয়ায় কারণে দেখা দিচ্ছে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়। বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন। এতে হাজার হাজার যাত্রী দুর্ভোগে পড়ছেন।