কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীমা মালিকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে নজর দেয়া ও মানব কল্যাণে বীমা শিল্প ব্যবহারের জন্য বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বীমা কোম্পানির মালিকদের শুধু মুনাফার দিকে নজর না দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানব কল্যাণের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতারণা থেকে বীমা গ্রাহকদের রক্ষা করতে একটি ঐক্যবদ্ধ বার্তা প্রদান প্লাটফর্ম চালু করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে উৎপাদন ও অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে বীমা কোম্পানিগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে বীমা সংক্রান্ত পঞ্চদশ আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রবীমা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বীমা কোম্পানিগুলো মানব কল্যাণে এবং উৎপাদন ও ঝুঁকিমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে তাদের বীমা কোম্পানি ব্যবহার করবে। আর তথ্যের অপ্রাপ্যতা বীমা গ্রাহকদের জন্য বড় সমস্যা। তিনি বলেন, বীমা শিল্পে গ্রাহকদের আস্থার অভাব রয়েছে। কারণ তারা বীমার যত কিস্তি জমা দিয়েছে, তার সবগুলো কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে আদৌ জমা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে অন্ধকারেই থেকে যায়। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে একটি ঐক্যবদ্ধ বার্তা প্রদান প্লাটফর্ম চালুর প্রক্রিয়া চলছে।
মিউনিক রি-ইন্স্যুরেন্স ও মাইক্রোইন্স্যুরেন্স নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) তিনদিনের এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। ৪২ দেশের চার শতাধিক বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বিআইএ প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম, ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটির চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, মিউনিক রি-ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান টমাস লোস্টার, মাইক্রোইন্স্যুরেন্স নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান ডবল চেম্বারলিন বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইএর প্রথম সহ-সভাপতি অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। অনুষ্ঠানে দেশের ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বীমা কোম্পানির মালিকদের প্রতি মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। বীমা শিল্পকে মানবিক কল্যাণে কাজে লাগাবেন। তিনি বলেন, উৎপাদন ও অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে বীমা কোম্পানিগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ব্যক্তি পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের অদৃশ্য ঝুঁকি হ্রাসে বীমাশিল্প সহায়তা করে। সম্ভাব্য ঝুঁকি কমিয়ে আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করে। জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিতে নিরাপত্তা দেয়। পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগ খাতের জন্য তহবিল সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য বীমা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও বীমা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশে বীমা ব্যবস্থার প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। এর প্রসার কাক্সিক্ষত মাত্রায় ঘটেনি। ফলে সামগ্রিক ক্ষতিপূরণ সম্ভবপর হলেও নি¤œ ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, জলবায়ুজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য বিশেষ ধরনের বীমা স্কিম এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ ধরনের বীমা ব্যবস্থা একটি নতুন ধরনের পদক্ষেপ। এটি অল্প সংখ্যক দেশে চালু হয়েছে এবং কিছু কিছু দেশে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
বীমা খাতের অবদানের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, দারিদ্র্যের হার আমরা উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সক্ষম হয়েছি। এতে বীমা খাতেরও অবদান রয়েছে। কেননা বীমা খাত সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহের মাধ্যমে বিনিয়োগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এর মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র তৈরি হয় এবং দারিদ্র্য দূর হয়। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বীমা শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান সরকার এই খাতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৩৮ সালে প্রণীত বীমা আইনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে আমরা বীমা আইন-১০ চালু করেছি। একইসঙ্গে আগের কন্ট্রোলার অব ইন্স্যুরেন্স অধিদফতর অবলুপ্ত করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বা আইডিআরএ আইন-’১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা নিশ্চিতের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার কয়েকটি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে হাওড় অঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সার্বিক ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে হাওড় অঞ্চলে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি নিরসনের লক্ষ্যে কৃষি বীমা চালু করা হচ্ছে। প্রবাসী কর্মীদের জন্য বীমা প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রবাসী কর্মী বীমা নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এতে প্রায় ১২ মিলিয়ন কর্মীর বীমা ঝুঁকি গ্রহণ সম্ভব হবে। এ বীমার আওতায় একজন প্রবাসী কর্মী সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার বীমা সুবিধা পাবেন। এছাড়া বীমা দাবি নিষ্পত্তি বীমা শিল্পের একটি পুঞ্জিভূত সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বীমা শিল্পকে বের করে আনা এবং গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে বীমা শিল্পে বিগত ২ বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বীমা দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে। দাবি নিষ্পত্তিতে কর্তৃপক্ষের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বজায় থাকায় দাবি নিষ্পত্তির হার আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তথ্যের অপর্যাপ্ততা বীমা গ্রাহকদের জন্য একটি বড় সমস্যা। যার ফলে কয় কিস্তি জমা হয়েছে, কিস্তির টাকা প্রধান কার্যালয়ে প্রকৃত অর্থে জমা হয়েছে কি না- সে বিষয়ে গ্রাহকরা অন্ধকারে থাকে। ফলে বীমা শিল্পের প্রতি গ্রাহকদের অনাস্থা বৃদ্ধি পায়। ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকরা প্রতারিতও হন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত মেসেজিং প্লাটফর্মের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যা বীমা শিল্পে ইউনিফায়েড মেসেজিং প্লাটফর্ম (ইউএমপি) নামকরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে উন্নয়ন মেলায় বীমা কোম্পানিগুলো অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন বিভাগে সব বীমা কোম্পানি নিয়ে বীমামেলার আয়োজন করছে। দেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শহরে অসংখ্য উঁচু ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব ভবনে অগ্নিকা- থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ভবন বীমা প্রচলনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেসব কোম্পানি এখন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি এমন ২৭ বীমা কোম্পানির তালিকাভুক্তির জন্য ’১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। বীমা শিল্পে লেনদেনে স্বচ্ছতা আনার জন্য ১০ হাজার টাকার উর্ধে সব লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পাদনের নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সব বীমা কোম্পানিকে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে হালনাগাদ অনিষ্পন্ন বীমা দাবির তালিকা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, জীবন বীমা কর্পোরেশন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির সক্ষমতা বৃদ্ধি, অটোমেশন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ৬৩২ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যক্রম ’১৮ সাল হতে চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পিতা-মাতার অবর্তমানে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ প্রবর্তনের কাজ চলমান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্সে আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে যোগদানের তারিখ পহেলা মার্চকে ‘জাতীয় বীমা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা এক সময় আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। সেই সুবাদে আমি বলব আমিও এই পরিবারের একজন সদস্য। স্বাধীনতার পর সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে জাতির পিতা বীমা শিল্পের উন্নয়নে ১৯৭৩ সালে দেশের একমাত্র এ্যাকচুয়ারি শাফাত আহমেদ চৌধুরীকে লন্ডন থেকে দেশে ডেকে আনেন এবং কন্ট্রোলার অব ইন্স্যুরেন্স পদে নিয়োগ দেন বলেও জানান তিনি।