চার এমপি সহ ৮০ জন দুদকের জালে ॥ ১৭ সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাব তলব

45

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযান আরো বিস্তৃত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চার সংসদ সদস্যের পাশাপাশি উচ্চপদে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপরও জাল ফেলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত রবিবার দুদক একটি চিঠিতে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে প্রায় ৮০ ব্যক্তির ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে, যাঁদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথসহ ওই চার এমপি ছাড়াও কর্মরত ১৪ জন এবং সাবেক তিন বড় সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত সাতজনের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই প্রকৌশলী।
বিএফআইইউর একটি সূত্র জানায়, দুদকের তালিকাটিতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ গণপূর্ত অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ১৪ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। তালিকায় সাবেক এক সংসদ সদস্যের নামও রয়েছে। ব্যবসায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, রাজধানীতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা, ক্রীড়া সংগঠকদেরও নাম রয়েছে তালিকায়।
দুদকের সূত্রগুলো জানায়, এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অনেক তথ্য দুদকের হাতে এসেছে। ফলে তাঁদের ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাব হাতে আসার পর ওই সব ব্যক্তির আয়কর ফাইলও সংগ্রহ করা হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেলে এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার আবেদন এবং তদন্ত শেষে মামলা করা হবে।
তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহ. রাজী হাসান বলেন, ‘চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এসব ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব চাওয়া হচ্ছে। এ তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। এ নিয়ে দুদকও কাজ করছে, আমরাও করছি। আমরা এখন পর্যন্ত ৪০ জনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছি। দুদক যাদের তথ্য চেয়েছে সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত গতকাল সোমবার সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তথ্য-প্রমাণ ও নথি সংগ্রহ করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। মামলার পর আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হবে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দুদক চিঠি পাঠিয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ অর্জনের অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে উঠছে, তাঁদের প্রত্যেককেই অনুসন্ধানের আওতায় আনবে দুদক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় বড় হয়ে উঠবে না। তাঁদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে।
দুদকের জালে ১৭ সরকারি কর্মকর্তা : বিএফআইইউর কাছে দুদক যাঁদের সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে তাঁরা হলেন শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে, নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক মধু, নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত উল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন, নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত সার্কেল-৩ ফজলুল হক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মোমিন চৌধুরী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল কাদের।
তালিকায় আছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক তিন বড় কর্মকর্তাও। তাঁরা হলেন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সি ও সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই। এ ছাড়া বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার নামও আছে এ তালিকায়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তার নামও রয়েছে তালিকায়। তাঁরা হলেন পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান এবং আরেক কর্মকর্তা সাজ্জাদ।
চার বর্তমান ও এক সাবেক সংসদ সদস্য তালিকায় : তালিকায় থাকা চার সংসদ সদস্য হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের মহাসচিব সামশুল হক চৌধুরী এবং সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। সাতক্ষীরা থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমানের নামও আছে এ তালিকায়। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীও রয়েছেন তালিকায়।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তিন কাউন্সিলর : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তিন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামও আছে তালিকায়। তাঁরা হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজিব এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ।
আওয়ামী লীগের পাঁচ, যুবলীগের ১১, স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই, কৃষক লীগের এক ও সাবেক ছাত্রলীগ দুজন : তালিকায় আছে ১১ যুবলীগ নেতার নাম। তাঁরা হলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ ও সোহরাব হোসেন স্বপন, সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, সহসভাপতি সরোয়ার হোসেন মনা, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ নেতা গাজী সরোয়ার বাবু, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি তাবিবুল হক তামিম।
তালিকায় আছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ। সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতার হিসাবও চেয়েছে দুদক। তাঁরা হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এস এম রবিউল হোসেন সোহেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান।
রাজধানীতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের পাঁচ নেতা আছেন তালিকায়। তাঁরা হলেন গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন মিয়া, সহসভাপতি রাশেদুল হক ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাতেনুল হক ভূঁইয়া ও গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা হারুনুর রশীদ। এ ছাড়া কলাবাগান থানা কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজের নামও আছে এ তালিকায়।
ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত চারজনের নামও আছে তালিকায় : দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত চারজনের নামও আছে তালিকায়। তাঁরা হলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের মহাসচিব শামছুল হক চৌধুরী, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম।
বান্দরবানের সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের সাতজন : বান্দরবানের সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মন্টু, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিম চৌধুরী স্বপন, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জামিল উদ্দিন শুভ, পরিচালক এস এইচ এম মহসিন, পরিচালক উম্মে হাবিবা নাসিমা আক্তার, পরিচালক জিয়া উদ্দিন আবীর, পরিচালক জাওয়াদ উদ্দিন আবরারের তথ্যও চেয়েছে দুদক।
ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ আরো ২৫ জন : তালিকায় আছেন গণপূর্তের ঠিকাদার জি কে শামীম, ব্যবসায়ী প্রশান্ত কুমার হালদার, আফসার উদ্দিন মাস্টার, আয়েশা আক্তার, শামীমা সুলতানা, শেখ মাহামুদ জোনায়েদ, মো. জহুর আলম, এস এম আজমল হোসেন, ব্রজ গোপাল সরকার, শরফুল আওয়াল, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির জাকির, নয়াটোলার সেন্টু ও শোভন, বাড্ডার নাসির, বনানী গোল্ড ক্লাবের আবদুল আওয়াল ও আবুল কাশেম, নোয়াখালীর মেসার্স জামাল অ্যান্ড কম্পানির স্বত্বাধিকারী জামাল হোসেন, পদ্মা অ্যাসোসিয়েটস ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের মিনারুর চাকলাদার, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের রেজোয়ান মোস্তাফিজ, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান, জি কে শামীমের দুই সহযোগী জিয়া ও নাঈম এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও নাদিম (ওমানে পলাতক)। এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকজন অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীর নাম আছে এ তালিকায়।