কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে চলমান দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের টার্গেটে থাকা মন্ত্রী, এমপি, হুইপ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও অঙ্গসংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিক লীগের ১৬১ জনের তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সরকার গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্তদের জন্য আগামী দিনে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি হবে অন্ধকারময়। সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, নানা অপকর্ম ও বিতর্কিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের ৬৭ এবং অঙ্গসংগঠনের ৯৪ মিলে মোট ১৬১ জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তারা। তদন্তের সত্যতা পাওয়ার পরই ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সভাপতি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের অব্যাহতি ও অন্যান্যের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা, আবার কারও বিরুদ্ধে ব্যাংক এ্যাকাউন্টস ফ্রিজ, গণভবনে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে ১৬১ জনের বিরুদ্ধে। পর্যায়ক্রমে আরও কঠিন পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
জানা গেছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গ্রেফতার হওয়া টেন্ডার কিং জিকে শামিম, যুবলীগের দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন স¤্রাট, কৃষকলীগ সভাপতি শফিকুল ইসলাম ফিরোজ, যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, অনলাইন ক্যাসিনোর প্রধান সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অপকর্মকারীদের নামের তালিকা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। যাদের নামের তালিকা পাওয়া গেছে তাদের অনেকেই এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যাদের নামের তালিকা পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার নামও আছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলছে সেখানে টার্গেটে রয়েছে আওয়ামী লীগের ৬৭ নেতা। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, অপকর্ম, স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাসী-ক্যাডার লালনপালনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ মন্ত্রী এবং ২৭ এমপির নাম রয়েছে। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি রয়েছেন ৩০ জন। ৭ জন রয়েছেন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাকর্মী। এই ৬৭ জনের যে তালিকা তার মধ্যে অঙ্গসহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোকে রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের অঙ্গসহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের আর ৯৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে এনেছে তদন্ত সংস্থা। ইতোমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। এর আওতায় ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সভাপতি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের অভিযোগের বিষয়ে সবুজ সংকেত পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে যুবলীগের সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হওয়ার বিষয়গুলো দলীয় হাইকমান্ডের কাছে প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নজরদারিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় স্থান পাওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে আওয়ামী লীগের যে ৬৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও। তাদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাণিজ্যে মদদ ও সহায়তা করা ছাড়াও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। দেশে টাকার পাহাড় গড়ে তুলে বিদেশে অর্থ পাচার করে অঢেল সম্পদ তৈরির অভিযোগ আছে কারও কারও বিরুদ্ধে। একজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে ঢাকার বিভিন্ন থানার ওসি নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ। বর্তমান মন্ত্রিসভার ৩ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে ভূমি দখলের অভিযোগ। দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে টেন্ডারকাজে সহায়তা করার অভিযোগ। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই-বাছাই করার জন্য তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা।
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ২৭ এমপির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা, সন্ত্রাসে মদদ দান, টেন্ডারবাজদের সহায়তা করা এবং বিভিন্ন পেশী শক্তির মাধ্যমে জমি দখল এবং সম্পদ দখলের তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ করেছে তদন্ত সংস্থাটি। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী, যারা নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। টেন্ডার, সন্ত্রাস এবং স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বিরুদ্ধে সুর্নির্দিষ্ট অভিযোগের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে যে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিবিরোধী আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযানের প্রথম পর্যায়ে ছাত্রলীগ, দ্বিতীয় পর্যায়ে যুবলীগ, তৃতীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ আক্রান্ত হচ্ছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ দিয়ে শুরু হলেও এই অভিযান শুধু ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ভাতৃ প্রতিম সংগঠনগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। একটি সুর্নির্দিষ্ট তালিকার মাধ্যমে অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যেখানেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলের বাইরেও যারা দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ অনিয়মের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন তাদের বিরুদ্ধেও পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হবে। প্রথমে ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করলেও পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন দলের বাইরেও এর পরিধি গিয়ে ছড়াতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালিত হবে না, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যারা মদদ দিয়েছেন, যারা তাদের এসব অনিয়ম, অপকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যারা সহযোগিতা করেছেন বা জড়িত ছিলেন তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার দাবি।