কাজিরবাজার ডেস্ক :
জুয়ার আসর ক্যাসিনো টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি ও ঘুষের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বিদেশে। দুই হাজার কোটি টাকা তো ঘুষই দিয়েছেন টেন্ডার কিং জি কে শামীম। আওয়ামী লীগ যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও ক্যাসিনোর সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বস্তা বস্তা টাকা লুটে নিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ‘টেন্ডার কিং’ জি কে শামীম, কৃষকলীগ নেতা ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি সফিকুল আলম ফিরোজকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগের যেসব নেতাকর্মী ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত হয়ে সরকারের ‘ক্লিনইমেজ’ বিনষ্ট করছে তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ক্যাসিনো টেন্ডারবাজি দুর্নীতি ঘুষ সন্ত্রাস চাঁদাবাজি দখলদার হিসেবে বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী এমপি, দলীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী অনেক রাঘব বোয়ালের মধ্যেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গত এক সপ্তাহে সারাদেশে নামী-দামী ক্লাবসহ সর্বত্র ক্যাসিনো ও জুয়া আসর বন্ধ হয়ে গেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি সম্রাট, ভোলা-৩ আসনের এমপি শাওনসহ কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে তাদের ব্যাংক লেনদেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যেসব মামলা হয়েছে সেসব মামলার তদন্তভার ন্যস্ত করা হচ্ছে র্যাব ও ডিবির হাতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব রাঘব বোয়ালের নাম তদন্তে আসছে সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া তাদের কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। এমন রাঘব বোয়ালদের নাম আসছে তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাই বিব্রত। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ফলে ক্লাবগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। ক্যাসিনোর বস্তা বস্তা টাকা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। এরই মধ্যে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দিয়ে আবার বিদেশে আনন্দ ফুর্তি বিনোদনে খরচ হয়ে গেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। চলমান অভিযানের মুখে রাজধানীর অধিকাংশ ক্লাবই বন্ধ। আর যাতে চালু না হয় সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবৈধ অনেক ক্যাসিনোর বিষয়ে আগে থেকেই জানত পুলিশ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ বিষয়ে এত দিন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম ও কৃষকলীগ নেতা ফিরোজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্তে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা হলেও তাদের বিরুদ্ধে মাদক, মানিলন্ডারিং ইত্যাদির অভিযোগ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার এসব নেতা ক্যাসিনোর বিষয়ে পুলিশকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। ক্যাসিনোর সঙ্গে পুলিশের অনেক উর্ধতন কর্মকর্তার যোগসাজশ পাওয়া গেছে। বেরিয়ে আসা ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার নামও। গত বুধবার ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোয় র্যাবের অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হয়। শুক্রবার নিকেতন থেকে গ্রেফতার করা হয় জি কে শামীমকে। একই দিন গ্রেফতার হন কৃষক লীগ নেতা সফিকুল আলম ফিরোজ। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোয় অভিযান চালানো হয়েছে। এরই জেরে খালেদ, শামীম, ফিরোজ, সম্রাট ও শাওন এমপিসহ কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। এরপর গে-ারিয়ায় দুই আওয়ামী লীগের নেতাসহ ৪ জনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সিন্দুকভর্তি টাকা জব্দ করা হয়েছে।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ২১৫। এদের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা হয়েছে ২০১ জনের। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম ও কৃষক লীগ নেতা ফিরোজসহ ১৩ জন রিমান্ডে আছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যেসব জায়গায় ক্যাসিনো এবং বড় বড় জুয়ার আড্ডা চলে সেসব জায়গার তালিকা অনেক দীর্ঘ। ক্যাসিনোর বিষয়ে এ পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে। সেগুলোর তদন্ত করবে র্যাব ও ডিবি।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ, শামীম, সফিকুল গ্রেফতর হওয়ার পর নানা ধরনের তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
ক্লাবগুলোতে প্রতি রাতে কোটি কোটি টাকার খেলার ভাগ বাটোয়ারা হলেও মাত্র তিন জন গ্রেফতার হওয়ার পর আর কোন গ্রেফতার না থাকায় সবাই বিস্মিত। ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন- ক্যাসিনো তো বন্ধ হবেই, পাশাপাশি সিসা বারও বন্ধ হবে। কারণ সিসা বারে এখন মাদক খাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় হেলথ ক্লাব বা স্পার নামে অবৈধ নারী ব্যবসা হচ্ছে- সবকিছুই পুরোপুরি বন্ধ হবে। ডিজে পার্টির নামে উলঙ্গ নাচ চলবে না। অসামাজিক কার্যকলাপ ও অবৈধ কোন কর্মকান্ড চলতে দেয়া হবে না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাসিনোকান্ডে জড়িত, টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ নেতাদের অনেকে এরই মধ্যে গাঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশির ভাগ কাউন্সিলরকে তিন দিন ধরে কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না। বন্ধ রয়েছে ঢাকা শহরে যুবলীগের কার্যালয়গুলোও। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যুবলীগ কার্যালয়ে গিয়ে কোন নেতাকে দেখা যায় না।
ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের ঘনিষ্ঠ কয়েক নেতা এরই মধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। দক্ষিণ যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য জাকির হোসেন ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযানের পরদিনই দেশ ছেড়েছেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। সম্রাটের প্রায় ৩শ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে জাকিরের কাছে। জাকির হোসেনের পল্টনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের কেউ বাসায় নেই। লোক ভাড়া করে রাতারাতি সেগুনবাগিচা, পল্টন লাইন এলাকায় সাঁটানো তার পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, বিলবোর্ড, ফেস্টুন সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের অন্যতম দাপুটে নেতা গুলিস্তান এলাকার ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে অভিযানের পর থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বস্তায় ভর্তি করে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে সপরিবারে গাঢাকা দিয়েছে এই যুবলীগ নেতা। ক্যাসিনোর টাকায় সন্ত্রাসী লালন করে গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়াসহ পাঁচটি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন শাহাবুদ্দিন। ক্যাসিনো শাহাবুুদ্দিনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী আছে যাদের দিয়ে ক্যাসিনো পরিচালনা করত। যুবলীগ নেতার সন্ত্রাসী বাহিনীর ক্যাডার হেলাল, শাহ আলম চৌধুরী, সাজু, মনির, লিটন, উজ্জ্বল, বেলায়েত, রশিদ ইউসুফ, পিওন জামালকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ক্যাসিনো পরিচালনা ছাড়াও পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে ফুটপাথ, বিভিন্ন মার্কেটে দখল, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি করার অভিযোগ আছে। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের ক্যাসিনোর মালিক আলী হোসেন ও সম্রাটের ঘনিষ্ঠ শাহাবুদ্দিনকে ওই ক্লাবের ক্যাসিনোর আয় থেকে প্রতিদিন দেয়া হতো হাজার হাজার টাকা। এলাকা থেকে শাহাবুদ্দিনের বিলবোর্ডও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
ক্যাসিনো শাহাবুদ্দিন ছাড়াও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ যে কজন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিয়মিত সিঙ্গাপুরে গিয়ে জুয়া খেলেন তাদের অন্যতম রবিউল ইসলাম সোহেল। তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ উত্তরের সাবেক সভাপতি। আগামী দিনে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী। ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত এই সোহেলও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন বলে তার নিকটজনরা জানিয়েছেন। মিজানুর রহমান মিজানের বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে। ‘টেন্ডার কিংস’ শামীম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলীকে ১২শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। টাকা না দিলে ওই প্রধান প্রকৌশলী বিল আটকে দিতেন। এত টাকা দিয়ে লাভ করব কীভাবে। এ জন্য অনিয়মের আশ্রয় নেন। আলোচিত জি কে বিল্ডার্স কোম্পানির ‘বালিশ’ কা- ঘটানোর পেছনেও এটি অন্যতম কারণ বলে শামীম জানিয়েছেন।