পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

111

ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর

ইসলামী জিন্দেগীতে বরকতময় ও ঐতিহাসিক যে দিবসগুলি রয়েছে তারমধ্যে পবিত্র আশুরা হচ্ছে অন্যতম একটি দিবস। আশুরা শব্দটি আরবী ‘আশরুন’ থেকে উদগত। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হিজরী সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ম তারিখকে পবিত্র আশুরা বলা হয়ে থাকে। ইসলামী সন গণনায় মহররম মর্যাদাবান একটি মাস। মহররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এ মাস সহ আরো ৩টি মাস আছে যে মাসগুলোতে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। এ রকম নিষিদ্ধ কর্মকান্ড থেকে এ মাসটি পাক-পবিত্র বলে এ মাসকে মহররম বা পাক পবিত্র মাস বলা হয়ে থাকে। এ মাসে স্বয়ং রাসূল (সঃ) নিজেও কোন ধর্মযুদ্ধও করেননি। এমনকি ইসলাম পূর্ব যুগেও এ মাসে শান্তি বিরাজ করতো। মুহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব- এ চারটি মাসকে আল্লাহ তা’য়ালা যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষেধ করে পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হয়েছে ‘‘তোমরা জেনে রেখ, এই চারটি মাস বড় ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের উপর জুলুম করো না’’ তাওবা-৩৬-৩৭। স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায়, এসব মাসে নেক আমল করলে ছাওয়াব অনেক বেশী হবে এবং উল্লেখিত চার মাসের মধ্যে মুহররমের ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম।
এ দিনে ঘটে যাওয়া কিছু ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা : পবিত্র আশুরা মুসলিম ঐতিহ্যে বড়ই বরকতপূর্ণ ও নানাভাবে অবিস্মরণীয়। ইসলামপূর্ব যুগেও এ দিনকে খুব মর্যাদা সহকারে পালন করা হতো। সৃষ্টির শুরু থেকে এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। কুরআন, হাদিস ও ঐতিহাসীকদের কাছ থেকে যা জানা যায়, তা হলো-
পবিত্র আশুরার দিনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সাগর, পাহাড়, প্রাণীকুল, আসমান-জমিন ও লওহ-কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার এদিনেই আরশে আজীমে সমাসীন হয়েছেন। তামাম মাখলুকাত ধ্বংসও হবে মহররমের দশ তারিখে। আল্লাহ পরওয়ারদেগার এ দিনে আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)কে তার খলিফা নিযুক্ত করেছেন আর জান্নাতে দাখিল ও পৃথিবীতে নির্বাসনের পর মক্কায়ে মুয়াজ্জমার আরাফাত ময়দানে হযরত মা হাওয়ার সাথে পরিচিত হয়েছেন’’ ও দীর্ঘদিন ক্ষমা প্রার্থনা শেষে দু’জনের তাওবা কবুল করেন। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ড হাবিল কাবিলের ঘটনাও এদিনে সংঘটিত হয়। হযরত নূহ (আঃ) সদলবলে মহা প্লাবন শেষে যুদী পাহাড়ে অবতরণ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন এ দিনে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ক্ষমতাশালী মূর্তিপূজারী নমরুদের অগ্নিকান্ড থেকে উদ্ধার হন এ দিনে, হযরত আইয়ুব (আঃ) কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি পান এ দিনে, হযরত ইউনুছ (আঃ) মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ এবং ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া (আঃ) শিশুপুত্র মুসা (আঃ)কে এ দিনই ফেরত পান। আল্লাহপাক এ দিনে হযরত ইদ্রিস (আঃ)কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানোর পর গুনাহ-অপরাধের জন্য কান্নাকাটি করলে আবার তাকে জান্নাতে ফেরত নেন। এ দিনই হযরত দাউদ (আঃ) এর গুনাহ মাফ হয়, কুমারী মাতা বিবি মরিয়ম (আঃ) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আঃ)’র পৃথিবীতে আগমন ঘটে। এ দিনই রহমতস্বরূপ আসমান হতে প্রথম বৃষ্টি নামে। হযরত সোলাইমান (আঃ) হাতের আংটি হারিয়ে সাময়িকভাবে রাজ্য হারা হলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ তা’য়ালা তার রাজ্য ফিরিয়ে দেন। হযরত ইউসুফ (আঃ) তার পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর এ দিনে সাক্ষাৎ লাভ করেন। হযরত মুসা (আঃ) তৎকালীন মিসরের বাদশাহ ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে এ দিনে তিনি বনী ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে নীল নদ পার হয়ে যান আর নদীর মাঝপথে পানি চাপা পড়ে ফেরাউনের সলিল সমাধি ঘটে। হযরত ঈসা (আঃ)কে আল্লাহ তা’য়ালা নিজ অনুগ্রহে এ দিনে আসমানে তুলে নেন। হযরত মুসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত এ দিন ইহুদি-খৃষ্টানদের মাঝেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হিযরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা এ দিনে রোজা রাখছে। তারা ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে আশুরা পালন করছে। মহানবী (সাঃ) আরো জানতে পারলেন যে, তারা হযরত মুসা (আঃ) এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এ দিনকে বেছে নিয়েছে। হুজুরে পাক (সঃ) উপলদ্ধি করলেন যে, হযরত মুসা (আঃ) এর প্রতি আমাদেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই তিনি ঐ দিনই রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদেরও রোজা রাখতে উপদেশ দিলেন। তবে ১০ মহররমের আগে পরে একটি রোজা বাড়িয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন যাতে মুসলমানদের ইবাদতের সাথে ইহুদি-খৃষ্টানদের ইবাদতের মিল না হয়।
আশুরার রোজার ফজিলত : আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং রমজান মাসের রোজার প্রতি। [বুখারি]
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম (মাসের রোজা)। [সহিহ মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। [সহিহ মুসলিম]
রোজা রাখার নিয়ম : ইসলামের দৃষ্টিতে আশুরা উপলক্ষে দুটি রোজা রাখা মুস্তাহাব। অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ। শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখা মাকরূহ। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটিতো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগামী বছর এদিন আসলে, আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাআল্লাহ। বর্ণনাকারী বলছেন, আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গিয়েছে।
আশুরার দিনে কিছু করণীয় কাজ : সম্ভব হলে উক্ত দিনে যারা রোজা রাখবে তাদের এক বা একাধিকজনকে ইফতার করানো। সাধ্যমত দান-সাদাকাহ করা। ৪. গরীবদেরকে পানাহার করানো। ৫. ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো ও তাদের সহযোগিতায় পাশে এসে দাঁড়ানো।
আশুরায় উদযাপিত কিছু অপসাংস্কৃতি যা বর্জন করা খুবই জরুরী : যেমন আশুরা উপলক্ষে চোখে সুরমা লাগানো, রাত্রে গোসল করা, মেহেদি লাগানো, ডাল-খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা মাকরুহ। বিশেষ করে হযরত ইমাম হাসান-হোসাইন (রা.) এর নামে যেভাবে বুক চাপড়ানো, রক্তাক্ত করা, তাজিয়া মিছিল করা ইত্যাদি এহেন কর্মকান্ড ইসলামে কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এটি চরম গোড়ামি ও বিদয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে এদিন উদযাপন করার তৈফিক দান করুন আমিন
আশুরার শিক্ষা : ১০ মহররম মুসলামানদের নিকট খুব তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ দিন হিসেবে পালিত হলেও ৬১ হিজরীর ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ (সঃ) এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ) এবং তার স্বপরিবার দামেস্কের অধিপতি ইয়াজিদের অসভ্য সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করলে এদিন গোটা মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে ঐতিহাসিক “কারবালা দিবস” হিসেবেও উদযাপিত হয়ে আসছে। বাতিলের কাছে মাথা নত না করে ইসলামি ঝন্ডা উঁচু রাখতে ও নীতি, আদর্শ, সত্য, মানবতা ও মুক্তির জন্য নিঃসংকোচচিত্তে এ ভাবে প্রাণদানের ঘটনা গোটা বিশ্ব জাহানে বিরল। কপটচারী, শৈরাচারী, জুলুমবাজ ও অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত ফৌজের অসত্যের মুকাবিলায়, ঈমানি জজবা ও অকুতোভয় মনে হযরত হোসাইন (রাঃ) যে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বে তা কালজয়ী ইতিহাস হয়ে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে। যুগ যুগ ধরে এটি মানবতার মুক্তির জন্য, ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলার খোরাক জোগাবে এবং ন্যায়ের ঝান্ডাবাহীদের অতুলনীয় শিক্ষার বিষয় হয়ে থাকবে। কবি বলেছেন ‘‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায় কারবালা কে বাদ’’ অর্থাৎ কারবালা যুদ্ধের পর ইসলাম সত্যিকার অর্থে পুনর্জীবিত হল।