দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৪তম বার্ষিকী আজ

27

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ ১৭ আগষ্ট। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৪তম বার্ষিকী। ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন পরিকল্পিতভাবে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় ৫০০ পয়েন্টে একই সময়ে বোমা হামলা চালায়। এতে দুজন নিহত এবং বিস্ফোরিত বোমার স্লিন্টারের আঘাতে অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলায় দায়েরকৃত ১৫৯ মামলার মধ্যে ৯৩ নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে ৩৩৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। বাকি ৫৬ মামলা এখনও বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা চার শ’। ১৪ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশব্যপী ৬৩ জেলায় সংঘটিত এই সিরিজ বোমা হামলায় মোট ১৫৯ মামলা দায়ের করা হয়। ১৪৯ মামলার ১১০৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অন্য ১০ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এই পর্যন্ত ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সিরিজ বোমা হামলার ২৭ আসামিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার মামলায় ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব মামলায় আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৪৯ অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৬৩ জেলার সাড়ে ৪শ’ স্থানে একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ দিনকে সামনে রেখে ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ হামলার মধ্যে দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল জেএমবি। আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন। আহত হন চার শতাধিক নারী-পুরুষ। অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পরও সংগঠনের সদস্যরা নামে-বেনামে, ছদ্মনামে এখনও তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ করতে হাইকোর্টে আপীল করেছেন ২৯ জঙ্গি। ফাঁসির দন্ড থেকে বাঁচতে হাইকোর্টে আপীল করেছেন জেএমবির ২৯ জঙ্গি হলো- হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ওরফে হায়দার, নারায়ণগঞ্জের সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন ওরফে সজিব, নওগাঁর নিয়ামতপুরের আবদুল কাইউম, বগুড়ার শেরপুরের হাফেজ মিনহাজুর ইসলাম ওরফে সোহেল রানা ওরফে সানোয়ার হোসেন, জামালপুরের মোঃ আক্তারুজ্জামান, খুলনার তরিকুল ইসলাম ওরফে রিংকু, ঝিনাইদহের মনিরুল ইসলাম ওরফে মোকলেছ, নাসনসরুলাহ ওরফে শান্ত, ঝিনাইদহের রোকনুজ্জামান ওরফে সিবুন, গাইবান্ধার আবু তালেব আনছারী ওরফে বাবুল আনছারী, ঝিনাইদহের মোহন, মামুনুর রশিদ, ঝিনাইদহের মুহিদ আহম্মদ, মোজাম্মেল হক ওরফে মোজাম, তুহিন রেজা, সবুজ আলী, শৈলকুপার ফারুক হুসাইন, গাইবন্ধার মতিন মেহেদী ওরফে মতিনুর ইসলাম, ঝিনাইদহের মহিরুল আল মামুন ওরফে চাদ, ঝিনাইদহের বিলাল হোসেন, সাবউদ্দিন, শৈলকুপার রবজেল হোসেন, আজিজুর রহমান।
রাজধানী ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলায় মোট ১৮ মামলা হয়েছে। যার মধ্যে চারটি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে। পাঁচটি মামলা বিচারাধীন আছে এবং বাকি নয়টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। চারটি বিচার নিষ্পত্তিকৃত মামলায় ৩৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে ১০ বছর। রাজধানীর ৩৩ স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮ মামলা দায়ের হয়। এই ১৮ মামলার মধ্যে ৫ মামলায় বোমার বাহককে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মামলার তদন্ত কাজ থেমে গেছে। এ বিষয়ে ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, র‌্যাবের হাতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জেএমবির ক্যাডারদের মাধ্যমে তথ্য বেরিয়ে আসছে যে তাদের কেউ কেউ ঢাকায় বোমা হামলার সময় বোমা বহন করেছিল অথবা বোমা বিস্ফোরণের তথ্য জানত। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী মামলাগুলোর তদন্ত কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
দেশজুড়ে ১৭ আগষ্টের পর শুরু হয় একের পর এক আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা। বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন চার শতাধিক। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার সেই ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আলোচিত হয়। জঙ্গি গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই সময় গ্রেফতার হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ প্রায় সাড়ে ৪শ’ জঙ্গি নেতাকর্মী। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঢাকা মহানগর বাদে সারাদেশে দায়ের করা হয় ১৩৮ মামলা। হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৪ শ’ গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে ৯ শ’ ৮১ জনকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।
র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সাংগাঠনিকভাবে জেএমবির কার্যক্রম একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে তাদের একেবারে নির্মূল করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাদের বড় ধরনের কোন নাশকতা ঘটানোর মতো ক্ষমতা আর নেই। জেএমবি গ্রেফতার করতে র‌্যাবের অভিযান চলছে। তাদের গতিবিধি নজরদারিতে আছে।
সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেএমবির জঙ্গি কার্যক্রমের ঘটনায় সারাদেশে ৩২২ মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চার্জশীট হয়েছে ২৮৯ টির। ১১৫ মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। ২৫ মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। ৮ মামলার তদন্ত কাজ চলছে। বিচার শেষ হওয়া ১১৫ মামলার মধ্যে ৯৫ মামলায় আসামিরা বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ১৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ১৮৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
শীর্ষ ছয় জঙ্গির ফাঁসি : ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাড়ে হত্যার ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে। ওই সময় বোমা হামলাকারী জেএমবি সদস্য ইফতেখার হাসান আল মামুন হাতে-নাতে ধরা পড়ে। এ দুই বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে আল মামুন ছাড়া ছয়জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, সহযোগী আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর জেএমবির কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে জঙ্গি তামীম চৌধুরী দেশে ফিরে এসে নতুন করে জেএমবিকে সংঘটিত করে। এর নাম দেয় নব্য জেএমবি। নব্য জেএমবি সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানোর চেষ্টা করে কিন্তু পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সফলতার সঙ্গে তাদের দমন করতে সক্ষম হয়।
পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, সিরিজ বোমা হামলার দিনকে সামনে রেখে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। জেএমবিসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো যাতে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য পুলিশ, র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটলিয়ন ও গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দেশে যখন জঙ্গি বিরোধী ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নির্মূলে কঠোর অভিযান চলছে, সে সময়ে সিরিজ বোমা হামলার ১৪তম বার্ষিকীতে জঙ্গি নির্মূলে জনগণের সম্পৃক্ততা অনেক বাড়াবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল জঙ্গি প্রতিরোধে এবং তরুণ প্রজন্মকে এ বিষয়ে সচেতন করতে কর্মসূচী গ্রহণ করছে।