কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ শনিবার। চান্দ্র মাসের হেরফেরে সৌদি আরবে ৯ জিলহজ্ব, বাংলাদেশে ৮ জিলহজ্ব। সে হিসেবে আজ সৌদি আরবে পবিত্র হজ্ব। কাল রবিবার সেখানে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। আজকের দিনটিকে বলা হয় আরাফা দিবস। বিশ্বের সোয়া ১৮ লাখ হজ্বযাত্রী আজ মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করেই “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” ধ্বনিতে হজ্বযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিনভর এবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন তারা। আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ্ব। এর আগে-পরে আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজ্বের পরিপূর্ণতা দেয়া হয়।
এবার আরাফাতের ময়দানে পবিত্র হজ্বের খুতবা দেবেন শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখ। আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেবেন তিনি। সৌদি আরবের প্রেস এজেন্সি এএসপি সূত্রে জানা যায়, হারামাইন আশ-শরিফাইনের খাদেম বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদ এক রাজকীয় ফরমান জারির মাধ্যমে এ বছর আরাফাতের ময়দানে খতিব হিসেবে শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখকে নিয়োগ দেন। শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখ সর্বোচ্চ উলামা বোর্ডের সদস্য এবং খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন হাদিস কমপ্লেক্সের প্রধান শাইখ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮১ সাল থেকে আরাফার ময়দানের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন দৃষ্টিহীন ইমাম শাইখ আবদুল আজিজ। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরে গিয়েছেন।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হজ্বের খুতবা প্রদান করেন শাইখ আবদুর রহমান আস-সুদাইস। ২০১৮ সালে আরাফার ময়দানে হজ্বের খুতবা প্রদান করেন বিচারপতি শাইখ হুসাইন ইবনে আবদুল আজিজ ইবনে হাসান।
হজ্ব মিশন থেকে জানানো হয়েছে, এবার বাংলাদেশসহ প্রায় ১৫০টি দেশ থেকে আসা ২০ লাখের বেশি মুসলমানের হজ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। এদের বেশিরভাগই সৌদি আরবের বাইরের নাগরিক। শুক্রবার রাতে মিনায় অবস্থান করেন। মিনায় ফজরসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পর তারা যাবেন মিনা থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত আরাফাতের ময়দানের দিকে। সাধারণত হজ্বযাত্রীরা নিজস্ব মোয়াল্লেমের ব্যবস্থাপনায় পাঠানো বাসে মিনার মাঠ থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে থাকেন। ফজর থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়। চলে দুপুর পর্যন্ত। হজ্বযাত্রীরা খোদার প্রেমে উন্মাদের মতো ছুটেন আরাফাতে। তাদের সঙ্গে থাকে শুধু একটি ব্যাগ, যাতে রাখা হয় কিছু অতীব জরুরী জিনিসপত্র। যেমন থালাবাসন, পানির মগ, ওষুধ ও অজু-গোছলের জন্য গামছাজাতীয় কাপড়চোপড়।
এবার মক্কার আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, হজ্বের সময় মক্কার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হতে পারে। আর্দ্রতা থাকবে ৮৫ শতাংশ। আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে, যা হজ্বযাত্রীদের জন্য কিছুটা হলেও আরামদায়ক হবে।
মিনার মাঠ থেকে হাব সভাপতি শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন-এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ্ব পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ (শনিবার) ভোর থেকেই হজ্বযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন। তাদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। মিনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশী হজ্বযাত্রীদের বিভিন্নভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। মিনার মাঠেও রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। কিছু হজ্বযাত্রী ফজরের নামাজের আগেই রাত তিনটার দিকে মিনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হবেন। আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা আছেÑহজ্বের মোট ফরজ কাজ হচ্ছে ৩টি। ইহরাম বাঁধা, ৯ জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা ও কাবাঘরে তাওয়াফ করা।
শুক্রবার মিনায় ছিল সোয়া ১৮ লাখ হজ্বযাত্রীর মিলনমেলা। এ বছর সারা বিশ্ব থেকে সোয়া ১৮ লাখ হজ্বযাত্রী এবং সৌদি আরবের নিজস্ব আরও প্রায় ২ লাখ হজ্বযাত্রী এবার হজ্ব আদায় করবেন। তারা সবাই মিনার মাঠে শুক্রবার এবাদত- বন্দেগীতে ব্যস্ত ছিলেন। লাখ লাখ সাদা তাঁবুতে সবাই পাশাপাশি অবস্থান করেন। অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে এ বছরও মিনার মাঠে রান্না করে খাবার তৈরির কোন ব্যবস্থা নেই। এসব হজ্বযাত্রীর সব খাবারই আসছে বাইরে থেকে।
হজ্বের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় আদায় করতেই হয়। তাই আজ মিনার মাঠে ফজরের নামাজের পর পরই হজ্বযাত্রীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তামাম জিন্দেগীর গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। এদিন জোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন তার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে। হাদিস মোতাবেক আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।
আরাফাতের মাঠে আজকের করণীয় হচ্ছে আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরার জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে একসঙ্গে একই আজানে জোহর ও আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরায় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমায় বা তাঁবুতে জোহর ও আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে এ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরার জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোহর ও আছর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহীহ্ হয়ে যায়। এ নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরার খতিব। হাদিস অনুযায়ী উকুফে আরাফায় অন্যতম করণীয় হচ্ছে দোয়া-মোনাজাত করা। এখানে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা রয়েছে। তাই পূর্ণ একীনের সঙ্গে দোয়া করতে হয়। উত্তম হচ্ছে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করা। এত দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো কঠিন হওয়ায় প্রয়োজনে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে দোয়া শুরু করা যেতে পারে। হাদিসে রয়েছে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজ্বযাত্রীর আসল হজ্ব হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজী হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজী রওনা হবেন।
মুজদালিফার আমল : আরাফাত থেকে এসে ৯ জিলহজ্ব দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুআককাদা। এদিন মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান ও এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এ রাতে ঘুমানো ও আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা, মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসূল (স.) এ রাতে এশা পড়ে শুয়ে গেছেন। যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা যায়। তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজীরা সারা রাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন। এছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মিনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে আগামীকাল হাজীরা একত্রে রওনা দেবেন ফের মিনার মাঠে। এদিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়। হজ্বের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়। কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে ১০ জিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। মিনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজীরা সরকারী ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজীরা মাথা মুন্ডন করে হালাল হয়ে যান। এরপর আবার তারা যাবেন মক্কা শরীফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা-মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজীরা ফিরে এসে মিনার মাঠে পর পর আরও ৩ দিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ।
এ বিষয়ে মিনার মাঠ থেকে হজ্ব টিমের এক কর্মকর্তা জানান-বাংলাদেশের সব হজ্বযাত্রীই ভাল আছেন। তবে শুক্রবার পর্যন্ত ৪৩ হজ্বযাত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এ ছাড়া কোন সঙ্কট বা সমস্যা নেই। এবারও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সর্র্বোচ্চ সংখ্যক হজ্বযাত্রী এসেছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। তারপরের সংখ্যাটি ভারত ও পাকিস্তান। চতুর্থ বাংলাদেশের ১ লাখ ২৭ হাজার। জেদ্দা থেকে প্রবাসী সাংবাদিক আবুল বশির জানান, নজিরবিহীন নিরাপত্তার মাঝে এবার হজ্ব ব্যবস্থাপনা সাজানো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে হজ্ব পালনের সুুবিধার্থে সৌদি সরকার সোয়া ১ লাখ নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া আরও ৪৫ হাজার স্পেশাল ফোর্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা হাজীদের নামাজ আদায় ও পথঘাট দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবেন। এবার হজ্ব মনিটরিংয়ে অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। হাজীদের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে চার হাজার দুই শ’ ক্যামেরা। ক্যামেরাগুলো প্রতিকূল আবহাওয়াতেও ৬০ কি.মি. পর্যন্ত এলাকার তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম।
জানা গেছে, সৌদি বিদ্যুত বিভাগ থেকেও হজ্ব উপলক্ষে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিবছর সফলভাবে হজ্ব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সৌদি বিদ্যুত বিভাগ একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। হজ্বের সময় মক্কা, মিনা, আরাফাহ এবং মুজদালিফায় কমপক্ষে ২৫ লাখ মানুষের উপস্থিতি ঘটে। এই সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৌদি বিদ্যুত বিভাগের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) হজ্বের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। হজ্ব উপলক্ষে মক্কার বিদ্যুত ব্যবস্থা দেখার জন্য আল-বারাক সৌদি বিদ্যুত বিভাগের মক্কা অফিস পরিদর্শন করেন। পরে মক্কার গবর্নরের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে গভর্ণরকে ওয়াকিবহাল করান।