কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং গুজব রটনাকারীদের প্রতিহত করতে দেশবাসীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গুজবে কান দেবেন না। কাউকে সন্দেহ হলে পুলিশের হাতে তুলে দিন। গুজব ও গণপিটুনির নামে মানুষ হত্যা জঘন্য অপরাধ ও পাপের কাজ। মিডিয়ার যারা আছেন তাদের বলব, অহেতুক ভুল তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। গুজব ও মিথ্যা তথ্য যারা ছড়াবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে নিজেদের ঘরবাড়ি, কর্মস্থল ও আশপাশের এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানোর পাশাপাশি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার নির্দেশ দেন তিনি। মঙ্গলবার টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের বিশেষ জরুরী সভায় যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
ডেঙ্গু মোকাবেলা ও গুজব রুখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। কেউ যদি অন্যায় করে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করুন। গুজবকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। গুজব ছড়িয়ে একজন মা’কে পিটিয়ে মেরে ফেললো, আজ সেই মায়ের শিশুটির কি অবস্থা? গুজব শুনে কোন নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলা গর্হিত কাজ, এটা হত্যাকান্ডের শামিল।
বিএসটিআই নিবন্ধিত পাস্তুরিত দুধে ‘মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান’ থাকার অভিযোগের পেছনে ‘আমদানিকারকদের কারসাজি’ আছে কিনা- সেই সন্দেহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করলাম, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই দুধ পরীক্ষা করে একজন বলে দিলেন যে, দুধ ব্যবহারযোগ্য নয়। সঙ্গে সঙ্গে রিট করা হয়। সেই কারণে বলে দেয়া হয় পাঁচ সপ্তাহ দুধ ব্যবহার করা যাবে না বা পাস্তুরিত করা যাবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার যখন দুধের খামার করে গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর হতে উৎসাহিত করছে, পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে খাদ্যপণ্য রফতানিতে জোর দিচ্ছে, তখনই হঠাৎ এই তথ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর পথে কেন বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে? তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে আমদানিকারক যারা, তাদের কোন কারসাজি আছে কি না এটাও দেখা উচিত বা তারা কোনভাবে উৎসাহিত করছে কিনা।
দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিয়ে ‘গুজব ছড়িয়ে’ রফতানি কাজে সমস্যা সৃষ্টি করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এই বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত দেন, তাদেরও ভাবা উচিত, ভেবে দেখা উচিত, যে হঠাৎ একটা কথা বলে গুজব ছড়িয়ে আমাদের রফতানি কাজে সমস্যা সৃষ্টি করা, দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাক- এই আতঙ্ক সৃষ্টি করা বা দেশে উৎপাদিত পণ্যের মান সম্পর্কে কথা বললে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কাজেই এইসব বিষয়গুলো ভালভাবে জেনে তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা করা উচিত। তবে গুজব যারা ছড়াবে বা এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা বিভ্রান্ত করবে, তাদের ওপর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি না হঠাৎ করে একজন প্রফেসর সাহেব কী পরীক্ষা চালালেন, আর এই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে আদালতে রিট হলো। একে একে সব কোম্পানির দুধ উৎপাদন বন্ধ। এর ফলে দুধের ঘাটতিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। আবার যারা খামার করছে তারাই বা কিভাবে জীবনযাপন করবে? এই মানুষগুলোর কাছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য গরু কিনে দিয়েছি। এই মানুষগুলো যদি দুধ বিক্রি করতে না পারে, অর্থ জোগাড় করতে না পারে, তাহলে আর গরুকেই বা কি খাওয়াবে? নিজেই বা কি খাবে? এই বাস্তবতাটা চিন্তা করা দরকার।
তিনি বলেন, আমদানিকৃত গুঁড়ো দুধের বিষয়ে কোন পরীক্ষা হয় না। তাই গুঁড়ো দুধ আমদানিকারকদের কোন কারসাজি এখানে আছে কি-না সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে যে সমস্ত গুঁড়ো দুধ আমদানি করা হয় আমি জানি না যিনি আমাদের দেশের দুধটা পরীক্ষা করেছেন, তিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা গুঁড়ো দুধগুলো পরীক্ষা করেছেন কিনা? আমার মনে হয় তিনি এটা কখনও করেন নেই। আমি অনুরোধ করব তিনি যেন বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, বাজারজাত করা হচ্ছে- সেগুলো যেন পরীক্ষা করে দেখেন। আমরা আমদানি নির্ভর থাকতে চাই না, স্বনির্ভর থাকতে চাই। আমরা দেশের চাহিদা দেশের উৎপাদিত পণ্য দ্বারা মেটাতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গবাদি পশুকে রোগমুক্ত রাখতে অনেক সময় এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। সেক্ষেত্রে দুধে কিছুটা এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে দুধের যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার কাজ করছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইদানীং একটি উপদ্রব দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু জ্বরটা যখন শুরু হয়, তখন আমরা দেখেছি, বিশেষ করে শহর এলাকায়, ঢাকা শহরের এর বিস্তার ছিল। তবে এটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে কোরবানির ঈদের সময় মানুষ বাড়িতে যাবে। যারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বা যাদের শরীরে এই বীজটা রয়ে গেছে, তারা আবার নিজ নিজ এলাকায় গেলে পরে সেখানে যদি মশা কামড় দেয়, তাহলে হয়ত অন্য কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সবাইকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার ‘অনুরোধ’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার নিজ নিজ ঘরবাড়ি, কাপড়-চোপড় যেগুলো আলনায় ঝুলানো থাকে, বাক্সে বা আলমারিতে থাকে; সেগুলো পরিষ্কার রাখা, ঘরের সকল কোণা, সবকিছু পরিষ্কার করে রাখতে হবে। তিনি বলেন, এডিস মশা বংশবিস্তার করে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে। সে কারণে বৃষ্টির পানি যেন কোথাও জমে না থাকে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, এডিস মশা বেশিরভাগ সময় পায়ের দিকে কামড়ায়। সে কারণে পা ঢেকে রাখতে হবে, ঘুমানোর সময় মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাতে হবে।
ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি আমাদের যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী সংগঠনকে আহ্বান জানাব, আমাদের কর্মীরাও যেন মাঠে নেমে পড়ে।’ ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী থেকে শুরু করে সব ধরনের সংগঠনকে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এয়ার কন্ডিশনের পানি, ফ্রিজের পানি, ফুলে টব বা ফুলদানির পানিসহ টায়ার, ভাঙ্গা হাড়িতে পানি জমে থাকে। সবাইকে পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেয়া দরকার।’
পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকার দুই মেয়রের সঙ্গে কথা বলে নির্দেশনা দেয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি সকলকে বলব, মশা যেন ডিম পাড়তে না পাড়ে, মশার লার্ভা যেন তৈরি না হয়, বংশবিস্তার করতে না পারে। এটা প্রত্যেক মানুষকে নিজেকেই করতে হবে, এটাই বাস্তবতা।’ সাংবাদিকদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়, সেজন্য নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। পাশাপাশি এটাও দেখতে হবে যে সকলে যেন সাবধান থাকে। কর্মস্থলে মশা যেন কামড়াতে না পারে, বংশবিস্তার করতে না পারে।
বন্যা মোকাবেলায় সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা সব সময় যোগাযোগ রাখছি। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন, তেমনি দলের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা নিচ্ছি। নদী ভাঙ্গন আমাদের একটি সমস্যা, নদী ভাঙ্গন থেকে নদীকে রক্ষা করতে হলে নিয়মিত নদী ড্রেজিং করা দরকার। আমরা সেই ব্যবস্থাই নিচ্ছি যে নদী ড্রেজিং করে এর গতির ধারাটা অব্যাহত রাখা। আর বর্ষাকালে যাতে এই পানিটা ধারণ করতে পারে সেই জায়গাটাও আমাদের রাখতে হবে। আমাদের খাল বিল, জলাশয়গুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা যত বাড়বে, বন্যার ঝুকিও কমবে নদী ভাঙ্গনও রোধ হবে।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করতে আওয়ামী লীগ এই জরুরী সভার আয়োজন করে। সভা চলাকালে প্রধানমন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মোবাইল ফোনে কল করে টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে সবার উদ্দেশে কথা বলেন। জরুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রগণ সভায় উপস্থিত ছিলেন।