এরশাদের জানাযায় রাষ্ট্রপতিসহ সর্বস্তরের মানুষ ॥ জীবন দিয়ে হলেও রংপুরে দাফন সম্পন্ন করার ঘোষণা উত্তর বঙ্গের নেতাদের

31

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জানাযায় ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের। সোমবার অনুষ্ঠিত দুটি জানাযায় ছিল মানুষের ভিড়। জানাযায় অংশ নেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, ডেপুটি স্পীকার এডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীসহ অন্যান্য সংসদ সদস্যগণ। এছাড়াও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন জানাযায়। জানাযার মধ্যেই এরশাদের কবর নিয়ে চলছে নানামুখী বক্তব্য। জীবন দিয়ে হলেও রংপুরেই দাফন সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের নেতারা। তাই নয়, এরশাদের দাফন রংপুরে করার লক্ষ্যে এরশাদের পল্লীনিবাস বাসভবন সংলগ্ন লিচু বাগানে সোমবারই কবর খোঁড়া শুরু করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আজ মঙ্গলবার সকালে হেলিকপ্টারে করে করে মরদেহ এরশাদের জন্মস্থান রংপুরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা শহরের ঈদগাহ মাঠে সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা শহরের ঈদগাহ মাঠে ‘পেয়ারা’ নামে পরিচিত রংপুরের সন্তান এরশাদের চতুর্থ জানাযা হবে। পরে ঢাকার ফিরিয়ে আনার পর দুপুরে বনানীর সেনা কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে বাংলাদেশের চতুর্থ সেনাপ্রধানের মরদেহ। সোমবার সকালে এরশাদের কফিন জাতীয় পতাকা ও সেনাবাহিনীর পতাকায় মুড়ে সোমবার সকালে জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয় রেওয়াজ অনুযায়ী আরেক দফা জানাজার জন্য। এ সময় এরশাদের ছোটভাই ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
পুরো সংসদ ভবন এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সংসদের দক্ষিণ প্লাজার বদলে জানাযার আনুষ্ঠানিকতা সারা হয় দক্ষিণ প্লাজার নিচের টানেলে। জানাজার পরে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের কফিনে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব, স্পীকারের পক্ষে সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস এবং ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিরোধী দলীয় নেতার কফিনে। জানাযার আগে এরশাদের জীবনী পড়ে শোনান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। বক্তব্য দিতে এসে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এরশাদের স্ত্রী সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ জানাযায় এসেছিলেন ছেলে শাদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে। সবার কাছে এরশাদের জন্য দোয়া চান রওশন। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, ডেপুটি স্পীকার শেখ ফজলে রাব্বী মিয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী সেখানে জানাজায় অংশ নেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও জিএম সিরাজ যোগ দেন জানাযায়। জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, মুজিবুল হক চুন্নু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানাযায় অংশ নেন।
সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে জানাযা শেষে এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর কাকরাইলে, তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে। নেতা-কর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সেখানে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাখা হয় এরশাদের মরদেহ। সেখানে তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান দলীয় নেতাকর্মীরা। দুপুর ১২টায় এরশাদের মরদেহ কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আনা হয়। এরশাদের মরদেহ দেখতে সকাল থেকেই অসংখ্য ভক্ত, নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অশ্রুচোখে শেষ বারের মতো প্রিয় নেতাকে দেখেন নেতাকর্মীরা।
এরপর বিকেলে এরশাদের তৃতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। যেখানে সর্বস্তরের জনতার ঢল নামে। সোমবার বাদ আছর শেষে তার জানাযা পড়ান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব মিজানুর রহমান। জানাযায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, রুহুল আমিন হাওলাদার, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রমুখ। জানাযার পূর্বে দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা এরশাদের জীবনী তুলে ধরেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য তার বিপুল অবদান। ইসলামের জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন। মানুষ হিসেবে কথা ও কাজে ভুলক্রটি থাকতে পারে। আমি এরশাদের ভাই হিসেবে ক্ষমা চাই। দোয়া চাই। তাকে সবাই ক্ষমা করে দেবেন। তাকে যেন আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। এর আগে বিকেল ৫টায় সাবেক রাষ্ট্রপতির মরদেহ ফ্রিজার ভ্যানে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আনা হয়। জানাযায় অংশ নিতে আসরের নামাজের এক ঘণ্টা আগে থেকে এরশাদের অসংখ্য ভক্ত, নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মসজিদে ভিড় করেন। জাতীয় মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জানাযা শেষে মরদেহ পুনরায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
জীবন দিয়ে হলেও রংপুরেই দাফন সম্পন্ন করার ঘোষণা উত্তরবঙ্গের নেতাদের : এদিকে, জীবন দিয়ে হলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রংপুরের মাটিতে দাফন সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির উত্তরবঙ্গের নেতারা। এজন্য দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীসহ এরশাদ ভক্তদের প্রয়োজনে আন্দোলনে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সোমবার দুপুরে রংপুর সেন্ট্রাল রোডে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলার নেতৃবৃন্দের জরুরী সভা থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগরের সভাপতি সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় দুই বিভাগীয় শীর্ষ নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বক্তব্যে নেতারা বলেন, জাতীয় পার্টিকে দাবিয়ে রাখতে ও সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে কেন্দ্রের গুটি কয়েক নেতা দাফন নিয়ে রাজনীতি করছে। তাদের এই রাজনীতি মেনে নেয়া হবে না। আমরা এরশাদের সমাধি জাতীয় তিন নেতার সমাধির পাশে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ওনারা জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিলীন করতে সামরিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করতে চান। যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এটা ষড়যন্ত্র। এরশাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা আদর্শকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। সামরিক কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত দলের কেউই মানেন না। যেকোন মূল্যে রংপুরের মাটিতেই দাফন করা হবে। সভাপতির বক্তব্যে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, এরশাদ স্যারকে জাতীয় নেতার মর্যাদা দিয়ে সমাহিত করা হলে আমরা মানতাম। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। স্যারের মরদেহ ও দাফন নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। রংপুরের পুত্রবধূ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করব, আপনার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনি জনগণের আকুতি বুঝেন। জনগণের চাওয়া-পাওয়া দাবি কি তা বুঝেন। প্রধানমন্ত্রী আপনি বলে দিন, আমাদের সন্তানকে রংপুরের মাটিতে সমাহিত করার জন্য।
আজ মরদেহ নেয়া হবে রংপুরে : প্রতিবছর ঈদ-উল আযহাতে যে মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলত এরশাদ, সেই মাঠেই আবারও আসছেন, কিন্তু এবার কোন কথা বলতে নয়। নিথর দেহ হয়ে শেষ বিদায় নিতে আসছেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে সাবেক এই রাষ্ট্রপতির মরদেহ রংপুরে নেয়া হবে। বাদ জোহর রংপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে তার চতুর্থ জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে মরদেহ। এরশাদের মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠানিকতার জন্য রংপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাযা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সোমবার দুপুর থেকে মাঠে প্যান্ডেল নির্মাণ, মাইক সংযোগ স্থাপন ও মাঠ পরিষ্কার করা হচ্ছে। শোক প্রকাশ করে নগরজুড়ে চলছে জানাযায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মাইকিং। দলীয় নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করার পাশাপাশি কার্যালয়ে উত্তোলন করা হয়েছে কালো পতাকা।
পাড়া-মহল্লার মসজিদ মাদ্রাসাতে এরশাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে চলছে দোয়া মাহফিল ও কোরান খতম। জাতীয় পার্টির দলীয় কার্যালয়সহ নগরীর ৩৩ ওয়ার্ডে মাইকে কোরআন তেলাওয়াত প্রচারের পাশাপাশি শোক প্রকাশ করে ব্যানার ফেস্টুন সাঁটানো। দাফন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীসহ রংপুরবাসী চাইছেন রংপুরই হোক এরশাদ শেষ ঠিকানা। এনিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চলছে নানা তৎপরতা।
রংপুরের পল্লীনিবাসে কবর খুঁড়ছেন স্থানীয় নেতারা : জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দাফন রংপুরে করতে পল্লীনিবাসে তার কবর খুঁড়ছেন রংপুর জাপার নেতারা।