জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে – প্রধানমন্ত্রী

27

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জলাধার, ফসলি জমি ও পরিবেশ রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করার পর আমাদের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে সুপরিকল্পিতভাবে উন্নতি ঘটাতে হবে। আমরা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নগরীগুলোকেই উন্নত করতে চাই না বরং গ্রামগুলোতেও সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই।
সোমবার রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোড এলাকায় সাতটি আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রাজধানীর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন বা সরকারের নির্দেশিত কাজগুলো বাস্তবায়ন করেন, তাদের সুযোগ-সুবিধাটা দেখাও একটা কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বস্তিবাসীদের জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, বস্তিতে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করে। এত খারাপ অবস্থায় থাকতে হয়, তবু এত উচ্চ ভাড়া দিতে হয়। কাজেই ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বস্তিবাসীদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ভাড়াটা প্রতিদিন হিসেবেও দিতে পারবে, সাপ্তাহিক হিসেবেও দিতে পারবে, মাস হিসেবেও দিতে পারবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ সাতটি প্রকল্পের মধ্যে গণপূর্ত বিভাগ চারটি এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তিনটি প্রকল্প সম্পন্ন করে। পরে প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের গ্রেড-ওয়ান সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত তিনটি ভবনের মধ্যে আবাসন প্রকল্প ঘুরে দেখেন। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এডভোকেট শম রেজাউল করিম ও মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ শহীদ উল্লাহ্ খন্দকার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সাতটি প্রকল্পের একটি প্রামাণ্য ভিডিও চিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশীদের অনুকরণে নয় বরং নিজ দেশের পরিবেশে কথা ভাবনায় নিয়ে ফ্ল্যাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু বিদেশীদের অনুকরণ করলে হবে না। আমাদের ঘন বৃষ্টির দেশ, আমাদের হিউমিডিটি বেশি, সেগুলো মাথায় রেখেই আমাদের মতো করে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে ফ্ল্যাট বা বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষকে একটি মানসম্মত জীবনযাত্রা উপহার দেয়ার জন্য আমরা স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, আবাসন, কলকারখানা যা-ই নির্মাণ করি না কেন, তা সুপরিকল্পিত উপায়ে সম্পন্ন করতে চাই। আমরা এলোমেলোভাবে কোন নির্মাণ কাজের অনুমতি দিতে চাই না। দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যে কোন পরিকল্পনা করার সময় আপনাদের জলাশয়গুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, এগুলো পানির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এগুলো পানি ধরে রাখে, যা জলাবদ্ধতা হ্রাসে সহায়তা করে।
প্রয়োজনে সড়কগুলো যেন বাড়ানো যায় তা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করার জন্য শেখ হাসিনা স্থপতিদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি ভবন নির্মাণে পুকুর, খাল ও জলাশয়গুলো ভরাট করার মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের মনমানসিকতার জন্যই এখন আর ঢাকা শহরের খাল ও পুকুর দেখা যায় না। আমরা ইতোমধ্যে জলাশয়গুলো রক্ষায় পরিকল্পনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি।
বিগত ১০ বছরে সরকারের ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ২০২১ সাল নাগাদ একটি উন্নয়নশীল ও ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন. আমরা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি এবং এখন আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আগেই এই দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। তবে, আমরা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নগরীগুলোকেই উন্নত করতে চাই না, বরং গ্রামগুলোতেও সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই।’
রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে এসব প্রকল্প উদ্বোধনকালে সরকার প্রধান আরও বলেন, আমরা মন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ১ হাজার ৬৭১টি আবাসন প্রকল্প উদ্বোধন করেছি। আমি আশাকরি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে আবাসন সুবিধা পেয়ে তারা তাদের দায়িত্বের প্রতি আরও মনোযোগী হবেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই তিনি সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য রাজধানীতে আবাসন সুবিধা আরও ৪০ শতাংশ বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৪ সালে এটা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও ১৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ হাজার ৩৫০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া, ১৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ১ হাজার ৬৭৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এছাড়া আমরা ইতোমধ্যে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১ হাজার ৫১২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করে তাদের মধ্যে বিতরণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন সুবিধার জন্য ইতোমধ্যে ৬৪টি জেলায় ২ হাজার ৮১৬টি ডরমেটরি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তার সরকার সবার জন্য আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে নিম্নমধ্যম আয়ের জনগণের জন্য ৩৩ হাজার ৫২৬টি প্লট উন্নয়ন এবং ৮ হাজার ৯২২টি ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য নির্ধারণ করেছি। এরমধ্যে উত্তরা এপার্টমেন্ট প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য নির্মাণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও ১৮ হাজার ১০৫টি ফ্ল্যাটের উন্নয়ন এবং ৮ হাজার ৩৯টি ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ চলছে। আমরা দেশব্যাপী ১৮ হাজার ১৪৮টি প্লট উন্নয়ন এবং ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৮৭টি ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এসব প্লট ও ফ্ল্যাটের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে জনগণের আবাসন সমস্যা দ্রুত হ্রাস পাবে। তিনি বলেন, আমরা একটি লোককেও বস্তিতে বসবাস করতে দিতে চাই না। কাজেই আমরা রাজধানীর বস্তিবাসীর জন্য এখন ফ্ল্যাট নির্মাণ করছি। এরমধ্যেই মিরপুরে ৫৩৩টি ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া, বস্তিবাসীর জন্য আরও ১৬ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সুপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সময়োপযোগী হাউজিং ও বিল্ডিং রিচার্স ইনস্টিটিউট অর্ডিন্যান্স আইন পাস করেছি। রাজধানীর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপনার পরিকল্পনা ও নক্সা প্রণয়ন করতে প্রকৌশলীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, টাকা হলেই যে যেখানে যত্রতত্র ভবন বানাবে বা শিল্প কারখানা বানাবে সেটা করতে দিতে চাই না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে যত্রতত্র অনেক ইমারত গড়ে উঠেছে- এটা ঠিক। তারপরও আমি বলব, রাস্তাঘাট বিল্ডিং যাই হোক- পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষগুলোর জীবনমানটা উন্নত করতে পারব। বিদেশীদের অনুকরণে নয় বরং নিজ দেশের পরিবেশের কথা ভাবনায় নিয়ে ফ্ল্যাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু বিদেশীদের অনুকরণ করলে হবে না। আমাদের ঘন বৃষ্টির দেশ, আমাদের হিউমিনিটি বেশি, সেগুলো মাথায় রেখেই আমাদের মতো করে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে ফ্ল্যাট বা বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা উচিত।
রাস্তার জন্য জায়গা না ছেড়ে এবং অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা না রেখে স্থাপনা নির্মাণের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে যেখানে কর্মস্থলে যাবেন আপনার ফায়ার এক্সিটটা কোথায় সেটা জানবেন। ফায়ার এক্সটিংগুইশার কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটাও জানা দরকার। আমরা যাই করে দেই না কেন, সেটা একটু যতœসহকারে ব্যবহার করবেন। সেদিকে একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখবেন। জলাধার সংরক্ষণ, পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসের ব্যবহারে সচেতন ও সতর্ক থাকতে সবাইকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।