কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্ত্রীকে উত্যক্ত্যের প্রতিবাদ করায় রাস্তায় প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনেই ফিল্মিস্টাইলে পৈশাচিক কায়দায় স্বামীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় চলছে। সন্ত্রাসীদের ঝাপটে ধরেও স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন স্ত্রী। পরে পুলিশের কাছে স্বামী হত্যার হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন স্ত্রী। ঘটনার নির্মমতা প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। হাইকোর্ট খুনীরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুনীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে কড়া হুকুম দিয়েছেন। পুলিশ ইতোমধ্যেই দুজনকে গ্রেফতার করেছে। দোষী অন্যদের গ্রেফতার করতে বরগুনায় বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি।
গত বুধবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীরা রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে রিফাত শরীফকে। ঘটনার সময় তার স্ত্রীও রিফাতের সঙ্গে ছিলেন। তিনি হামলাকারীদের ঝাপটে ধরে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ফল হয়নি। আহত রিফাত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন বিকেলে মারা যান। ঘটনার সময় আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মোবাইল ফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিলে রীতিমত ভাইরাল হয়ে পড়ে। পুরো দেশে রীতিমত হৈচৈ পড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার দিকে ১২ জনকে আসামি করে রিফাতের পিতা দুলাল শরীফ বরগুনা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ঘটনার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়নকে। নয়ন এলাকায় নয়ন বন্ড নামেও পরিচিত। পুলিশ মামলার চার নম্বর আসামি চন্দনসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে।
বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতে রিফাত ঘটনায় দেশের বাংলা ও ইংরেজীসহ বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেন হাইকোর্ট। এদিনই রিফাতের হত্যাকারীরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে এজন্য দেশের সব থানায় এ্যালার্ট জারি করতে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
তিনি আদালতকে জানান, নিহত রিফাতের স্ত্রীসহ পরিবারকে সার্বিক নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আদালত জানায়, এ ব্যাপারে আপাতত আমরা কোন আদেশ বা রুল জারি করছি না। তবে এ মামলায় কোন অনিয়ম হয় কিনা তা আদালত নজরে রাখবে। আগামী ৪ জুলাই মামলার অগ্রগতির বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করে আদালত। রাস্তায় প্রকাশ্যে একজনকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারার ঘটনা এবং সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করা এবং কেউ বাধা না দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আদালত। এ সময় আদালতে রিফাত হত্যার বিষয়ে আদালতে পত্রিকার প্রতিবেদন উপস্থাপনকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল উপস্থিত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, বরগুনায় রিফাত হত্যার ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী খুনীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে কড়া হুকুম দিয়েছেন। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের যে কোন মূল্যে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। প্রেমঘটিত বিষয় হলেও ব্যক্তিগত বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেছে খুব নগ্নভাবে।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন এ্যাওয়ার্ড ২০১৯ অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যেই পুলিশ দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বরগুনায় সড়কে প্রকাশ্যে যুবককে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং বিচার হবে এবং হতেই হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ঘটনার পর ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ কথা বলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্ত্রীকে আয়েশা আক্তার মিন্নিকে বরগুনা সরকারী কলেজ থেকে বাসায় নিতে যান স্বামী রিফাত শরীফ (২৫)। সেখানে আগ থেকেই ওৎপেতে থাকা কয়েক যুবক রিফাতকে টেনে হেঁচড়ে বের করে পেটাতে থাকে। এর পর পরই সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে কয়েকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে রিফাতকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। মিন্নি চিৎকার করে আশপাশের লোকজনের সাহায্য চান। কিন্তু এক যুবক ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি। নিজেই ছুটে গিয়ে সন্ত্রাসীদের জাপটে ধরেন। সন্ত্রাসীদের কাছে কাকুতিমিনতি করেন। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের ধাক্কা দিয়ে পেছন থেকে স্বামীকে আঁকড়ে ধরেন। কিন্তু তার অনুরোধে কান না দিয়ে, তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রিফাতকে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। মাত্র চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘটে যায় লোমহর্ষক সেই ঘটনা। পরে রিফাত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওইদিনই বিকেলে মারা যায়।
রিফাতের স্ত্রীর দেয়া জবানবন্দী মোতাবেক, আমি অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারিনি। সন্ত্রাসীরা রাম দা নিয়ে আক্রমণ করে। আমি অনেক চেষ্টা করছি, অস্ত্র ধরছি, তাদের ধরছি, চিৎকার করছি। কেউ আগায়া (এগিয়ে) আসে নাই। কেউ আমারে একটু হেল্প করে নাই। আমি একলা হাসপাতালে নিয়া গেছি।
তিনি আরও বলেন, নয়ন তাকে রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করত। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিত। তাদের দুই মাস আগে বিয়ে হয়। বিয়ের আগ থেকেই তাকে উত্যক্ত করত নয়ন। ফোনে কথা বলার জন্য জোর করত। কথা না বললে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিত। রাস্তায় একা রিক্সায় থাকলে সেই রিক্সায় উঠে পড়ত। বিয়ের আগ থেকেই রিফাতের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।
দোষীদের যাতে আইনের আওতায় এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়, এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। নয়ন, রিফাত ফরাজি ও রিশান ফরাজির ফাঁসি কামনা করেন তিনি। এমন ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বরিশাল রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম। এদিকে রিফাত হত্যার ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলেজ ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরের রাস্তায় মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ করেছেন। কর্মসূচী থেকে খুনীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন জানান, রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতার করতে বরগুনার বিভিন্ন স্পটে চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ ও র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। সদ্য যোগদান করা বরগুনার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাইন বিল্লাল বর্বরোচিত এ ঘটনার সর্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত অন্যতম খুনী রিফাত ফরাজী। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফরাজী। রিফাতের হাতে বহু মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছেন। কারণে-অকারণে প্রতিবেশীদের মারধরসহ নানা অপকর্মে জড়িত রিফাত ফরাজী। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পায় সে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করেছিল আলোচিত খুনী রিফাত ফরাজী।
রিফাত ফরাজী বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডাঃ আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রকে জিম্মি করে তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনায় পুলিশ রিফাত ফরাজীর পিতা দুলাল ফরাজীকে আটক করে ১১টি মোবাইল উদ্ধার করেছিল। বরগুনা সরকারী কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে নয়ন বন্ডের বাসা। নয়নের পিতা মৃত ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর প্রবাসী হওয়ার কারণে মাকে নিয়েই ওই বাসায় বসবাস করে খুনী নয়ন। পুলিশের দায়ের করা মাদক মামলায় সম্প্রতি জামিনে বের হয় নয়ন। জেল থেকে বেরিয়েই আলোচিত হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়।
বরগুনা সদর থানার ওসি আবীর হোসেন মাহমুদ জানান, নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা সবার জানা। তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলা আছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুর একটার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে রিফাতের মরদেহ বুঝে নেন স্বজনরা। সেখানে রিফাতের শ্বশুর মোজাম্মেল হোসেনও ছিলেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানান, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রিফাতের মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে ৮টি কোপের চিহ্ন আছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রিফাতের মৃত্যু হয়। পরে এ্যাম্বুলেন্সযোগে সড়কপথে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রিফাতের গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। রিফাত ছিলেন তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান। লাশ বাড়িতে পৌঁছলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন পরিবারের লোকজন ও স্বজনরা। রিফাতের লাশ দেখতে শত শত মানুষ ভিড় জমান সেখানে। রিফাতের জানাজায় অংশ নেন শত শত মানুষ। ঘটনাটি সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পুরো এলাকার মানুষের মধ্যে রীতিমত শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তারা এই হত্যাকা-ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।