মো: শামসুল ইসলাম সাদিক :
মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী তৃতীয় আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল (সাঃ)-জন্মের দুই বছরের কিছু বেশী সময় পর আবু বকর (রাঃ)-জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম আবু বকর আস সিদ্দিক আব্দুল্লাহ ইবন আবী কুহাফা উছমান আত তাইমী আল কুরাইশী। ডাক নাম আবদুল্লাহ। তাঁর বাবা উসমানের কুনিয়া ছিল আবু কুহাফা। এজন্য আবু বকরকে আবদুল্লাহ ইবন আবী কুহাফাও বলা হয়ে থাকে। আবু বকর (রাঃ) এর ব্যক্তিগত নাম ছিল আব্দুল্লাহ, কিন্তু আরবের প্রথামত তিনি তাঁর ছেলের নাম বকর থেকে আবু বকর (বকরের পিতা) নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু কোহাফা এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল খাইর সালমা। রাসূল (সাঃ)-এর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সঙ্গী ছিলেন। নবীদের পর উম্মতকুলে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা সর্বোচ্চ বলেই বিবেচিত হন। আর সাহাবিদের মধ্যে যাঁর নাম অগ্রগণ্য, তিনি আবু বকর (রাঃ)। তিনি ছিলেন একাধারে রাসূল (সাঃ)-এর শ্বশুর, তাঁর হিজরতের সঙ্গী এবং বয়োজোষ্ঠ্য সাহাবাদের মধ্যে অন্যতম। ‘সিদ্দিক’ হচ্ছে তাঁর উপাধি। মিরাজের ঘটনাকে সর্বপ্রথম শুনে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিটি বাণী তিনি বিনা যুক্তিতে সত্য বলে মেনে নিতেন বলেই রাসূল (সাঃ)-তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর অন্য উপাধি আতিক বা আতিকুল্লাহ মিনান্ নার। তিনিই রাসূল (সাঃ)-এর একমাত্র সাহাবী, যিনি তাঁর সাথে সফরে ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবু বকর (রাঃ)-ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর প্রত্যক্ষ সঙ্গী, রাসূল (সাঃ) ও উম্মতের মাঝে সেতুবন্ধ রচনাকারী, কোরআনের নির্দেশ পালনে তিনি ছিলেন উন্মুক্ত। জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি ইসলামের বিধি-বিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। ইসলামের সূচনা পর্ব থেকে আমৃত্যু তিনি রাসূল (সাঃ)-কে ছায়ার মত অনুসরণ করতেন এবং রাসূল (সা:)-ও ইসলামের জন্য নিজের যথা সর্বস্ব কুরবানী দিয়েছেন।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে মুসলিম বিশ্বের শাসনকার্য পরিচালনা জন্য মুসলিম ইতিহাসে আবু বকর (রাঃ)-প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। রাসূল (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর সুন্নী বিশ্বাসমতে আবু বকর (রাঃ)-ছিলেন খোলাফায়ে রাশীদুন (অর্থাৎ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত) এর একজন খলীফা। প্রথম খলিফা নির্বাচিত হবার পর কিছু গোত্র প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকার করে বসে, কেবল এই কারণে যে, তাদের গোত্রীয় প্রধান রাসূল (সাঃ)-এর খলীফার প্রতি অনুগত থাকার আর প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু তাই নয়, তারা বরং নবপ্রতিষ্ঠিত খিলাফতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মদীনা আক্রমণের রণপ্রস্তুতি নিতে থাকে। আবু বকর (রাঃ)-তাদের অভিসন্ধি জানতে পেরে, সৈন্য প্রেরণ করেন এবং তাদের বিদ্রোহ কঠোর হস্থে দমন করতে সক্ষম হন। বিদ্রোহীদের দমন করার কিছুকাল পর বহু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করে, যা ইসলামী রাষ্ট্রের বিবিধ চাহিদা পূরণ এবং দরিদ্রদের তত্ত্বাবধানের জন্য অপরিহার্য ছিল। আবু বকর (রাঃ)-প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে এবং তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। যার জন্য আবু বকর (রাঃ)-কে ইসলামের ‘ত্রাণকর্তা’ বলা হয়। এ অবদানের স্বীকৃতির ব্যাপারে অনেক পূর্বে রাসুল (সাঃ)-বলেন, ‘দুনিয়াতে আমি প্রত্যেক মানুষের এহসানের পরিপূর্ণ বদলা আদায় করেছি কিন্তু সিদ্দিকে আকবরের ত্যাগের প্রতিদান আদায় করতে পারিনি। হাশরের ময়দানে স্বয়ং প্রভু তাঁকে ওই প্রতিদান দান করবেন।’ তাঁর পরবর্তীতে কিছুসংখ্যক ভন্ড ও উচ্চাকাংখী ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবী করে বসে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। মোসায়লিমাতুল কাজ্জাব এবং আসওয়াদ আনসী বিপুল সৈন্য সমারোহ করে এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা দখল করে নেয়। আবু বকর (রাঃ)-এই সকল বিদ্রোহী মিথ্যা নবুয়তের দাবীকারকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সৈন্য স্বল্পতা সত্ত্বেও রাব্বে কারিম দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেন। তাঁর খিলাফতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পবিত্র কুরআনকে একস্থানে সংগৃহিত করা। যদিও রাসূল (সাঃ)-স্বয়ং পবিত্র কুরআনের লিখন ও বিন্যস্তকরণ কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত তা বিবিধ চামড়ার টুকরা, বৃক্ষ পত্ররাজি এবং পাথরের ফালিতে লিখিত ছিল। আবু বকর (রাঃ)-এই সকল বিছিন্নভাবে লিখিত অংশকে সংগ্রহ করে একত্রিত করেন এবং কুরআন সংরক্ষণের নিমিত্তে হিফযকারীদের ব্যবস্থাপনাকে পদ্ধতিগত ভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে তাকেন।
আবু বকর (রাঃ)-ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও সত্যনিষ্ঠ। প্রথম জীবনে কুরাইশদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি এবং সৎ চরিত্রের জন্য সবাই তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মাণ করত। তা ছাড়া মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, সহায়-সম্বলহীনতায় এবং দুস্থদের সাহায্যার্থে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবু বকর (রাঃ)-সব সময়ই রাসূল (সাঃ)-কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। বদরের যুদ্ধে আবু বকর (রাঃ)-সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং নবীজীর খেদমতে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। রাসূল (সাঃ)-এরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে আবু বকরই বেশি দয়ালু।’ রাসূল (সাঃ)-আরো বলেন, ‘বন্ধুত্ব ও সাহায্য আবু বকরই আমাকে বেশি করেছিলেন। ইহ জগতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম।’ তিনি আরো বলেন : দুনিয়ায় এমন কোনো ব্যক্তির ওপর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়নি, যে পয়গম্বরদের পর আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ (রূহুল বয়ান)। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আবু বকর (রাঃ)-এর অবদান মহাপ্রলয়ের আগ পর্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। রাসূল (সাঃ)-তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করার জন্য এক সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন, যারা উত্তর সীমান্তে উপদ্রব করছিল। এই সৈন্যবাহিনী তখনও মদীনাতেই অবস্থান করছিল, রাসূল (সাঃ)-ইন্তেকালের পর আবু বকর (রাঃ)-খলীফা হওয়ার পর মদীনার ভিতর এবং বাইরের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়লো। এই মহা বিপদের আশঙ্কা করে, রাসূল (সাঃ)-এর অনেক সাহাবী তাঁকে এই পরামর্শ দিলেন যেন এই সৈন্য বাহিনী রোমানদের বিরুদ্ধে তখনই প্রেরণ না করা হয়। কিন্তু আবু বকর (রাঃ)-জোরের সাথে জবাব দিলেন, “আবু কোহাফার পুত্রের কি অধিকার আছে যে রাসূূল (সাঃ)-এর দ্বারা সূচিত কোন কাজকে রোধ করে”। মুসলিম সেনাবাহিনী খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বাহরাইনে এক বিদ্রোহকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তারপর পারস্যরা পরাজিত হয়, যারা বাহরাইনের বিদ্রোহীদের মদদ করছিল। মুসলিম সেনাবাহিনী অতঃপর ‘আজনাদান’ এবং ‘ইয়ারমুকে’র যুদ্ধে রোমান পরাশক্তিকে পরাজিত করে এবং এভাবে গোটা সিরিয়া ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।
তিনি খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি যত দিন আল্লাহ এবং রাসুলের নির্দেশিত পথে চলি, তত দিন তোমরা আমাকে অনুসরণ করবে এবং আমাকে সাহায্য করবে। আর ভুল পথে চললে তোমরা আমাকে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে দেবে। তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা আমার কাছে সবল ও শক্তিশালী। আর যারা সবল, তাদের কাছ থেকে হকদারের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা আমার কাছে দুর্বল।’ আবু বকর (রাঃ)-প্রদত্ত এ ভাষণ দুনিয়ার সর্বকালের শাসকদের জন্য অনুপম আদর্শ। আবু বকর (রাঃ)-পক্ষকাল অসুস্থ্য থাকার পর ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট মোতাবেক ১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে মহান সাহাবি ওফাত লাভ করেন। রাসূল (সাঃ)-এর রওজা মুবারকের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি ছিলেন সেই দশজন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্তের একজন যাঁদেরকে রাসূল (সাঃ)-সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তাঁদের জান্নাতে ভূষিত করা হবে। তিনি দু’বছরের কিছু অধিককাল খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা, কাজ ও বাণী আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। রাব্বে কারিম রাসূল (সাঃ)-এর প্রিয় সাহাবির আদর্শ মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।