মোঃ ফখরুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এই যে তাকওয়া- এর অবস্থান হচ্ছে অন্তরে। এ তাকওয়া মাপার বাহ্যিক কোন মাপকাঠি নেই। এ কথাই বলা হয়েছে এ হাদীসে-হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন নবীজী (সা.) বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না, তার সাথে মিথ্যা বলবে না, তাকে অবজ্ঞা করবে না। তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বললেন, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে। কোন মানুষের অকল্যাণের জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে তাচ্ছিল্য করবে। মুসলমানের সবকিছুই মুসলমানের উপর হারাম; তার রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত (বুখারী, মুসলিম)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের সমাজে এখন তাকওয়াকে একান্ত ব্যক্তি জীবন বা গুটিকতক নীতি কথা বা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফরজ-ওয়াজিব, হালাল-হারাম সম্পর্কে সম্যক অবহিত না হয়ে, যথাযথভাবে পালন না করে কিছু সুন্নাত কিংবা নফল কাজ করে মুত্তাকী হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।হাতে তাসবীহ, মাথায় টুপি-পাগড়ী, মুখে লম্বা দাড়ী, গায়ে লম্বা জামা, পেশাব-পায়খানায় ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করাইত্যাদি কিছু সুন্নাত, নফল বা কোন কোন ক্ষেত্রে বেদাতী আমলকরেই অনেকে নিজেকে মুত্তাকী হিসেবে জাহির করতে ব্যস্ত। এগুলো অপ্রয়োজনীয় বা সওয়াব অর্জনকারী নয় তা নয়, কিন্তু নিজেদের চোখের সামনে আল্লাহর দ্বীনকে ভূলুন্ঠিত হতে দেখে যার হৃদয়ে একটুও রক্তক্ষরণ হয় না, ফরজ-ওয়াজিব, হালাল-হারাম সম্পর্কে উদাসীন থেকে শুধু গুটিকতক সুন্নাত কিংবা নফল কাজ করে তিনি নিজেকে মুত্তাকী ভাবতে পারেন না। গুটিকতক আনুষ্ঠানিক সূন্নাত-নফল আমলকেই তাকওয়ার মাপকাঠি মনে করা সঠিক ধারণা হতে পারে না। অথচ আমাদের সমাজে এগুলোকেই তাকওয়ার মাপকাঠি মনে করা হয়। সকল প্রকার ফরয-ওয়াজিব মেনে চলা, যাবতীয় হারাম বর্জন করা, সৎকাজের আদেশ-অসৎকাজের প্রতিরোধ করা, দাওয়াতে দ্বীন, একামতে দ্বীন এগুলোর প্রতি উদাসীন থেকে শুধুমাত্র কিছু আনুষ্ঠানিক সুন্নাত-নফল আমল করে তাকওয়াবান হওয়া যায় না।প্রকৃত অর্থে, যারা ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাতের চেতনায় বলীয়ান হয়ে আল্লাহর দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজের জীবনে ও সমাজে কায়েমের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন তারাই প্রকৃত মুত্তাকী।
তাকওয়ার প্রধান উৎস হচ্ছে দুটি – ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাত এবং তা অর্জনের প্রধান উপায় হচ্ছে দুটি-ইলম (জানা) ও আমল (মানা)। এজন্য কুরআন মজিদের একাধিক জায়গায় মুমিনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে তাকওয়া অর্জনের এ দুটির গুণের কথা বলা হয়েছে। যেমন সুরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা বলে আমরা (আল্লাহর নির্দেশ) শুনেছি এবং (তা) মেনে নিয়েছি (২: বাকারা: ২৮৫)।” ইলম অর্জনই যে তাকওয়া অর্জনের প্রাথমিক সোপান একথা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন এভাবে –“আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর বান্দাদের মাঝে সেসব লোকেরাই বেশী ভয় করে যারা (এ সৃষ্টি নৈপুণ্য সম্পর্কে) জানে (৩৫: ফাতির: ২৮)।”এখন আমরা দেখব রামাদান কীভাবে আমাদের তাকওয়া অর্জনের এ উৎস ও উপায় সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।
ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাতের প্রশিক্ষণ : একমাত্র রামাদান এমন একটি ইবাদত যার কোন বাহ্যিক প্রকাশ নেই। যেখানে কেউ তাকে দেখে না এমন নির্জন স্থানে গিয়েও রোজাদার কোন কিছু পানাহার করে না এ বিশ্বাসে যে, কেউ তাকে না দেখলেও মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন এবং আদালতে আখেরাতে এ কাজের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এভাবে দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘন্টা করে তার এ প্রশিক্ষণ হয়। ফলে তার ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাত দিনে দিনে দৃঢ়তর হতে থাকে।
ইলম অর্জন : আমরা সকলে জানি কুরআন মজিদ হচ্ছে সকল ইলমের উৎস। রামাদান মাসে ব্যাপকভাবে কুরআন চর্চার জন্য উৎসাহিত করা হয়। জিব্রাইল (আ.) রাসূল (সা.) এর কাছে প্রতিবছর রামাদান মাসে একবার পুরো কুরআন পেশ করতেন, পুনরাবৃত্তি করতেন। অবশেষে রাসূল (সা.) এর ওফাতের বছর তিনি সেটা দুবার পেশ করেন; যাতে তা রাসূলের হৃদয়ে স্থায়ী ও স্থির হয়ে যায় এবং পাশাপাশি বিষয়টি জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমনটি করেছেন (বুখারি-৪৯৯৮)। এরই অনুসরণে রামাদানে খতম তারাবীহর প্রচলন হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে এ মাসে অনেকেই কুরআন খতম করে থাকেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা আরবী বুঝি না। নইলে চিন্তা করে দেখুন আমরা যদি আরবী বুঝতাম তাহলে প্রতি বছর রামাদানে যে পরিমাণ কুরআন চর্চা হয় তাতে মুসলিম সমাজে কুরআনের জ্ঞানের কত বেশী বিস্তার হত।
শরীয়ত মানার দীর্ঘ অভ্যাস সৃষ্টি করা : রামাদানের মত আর কোন ইবাদত এত দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মধ্যে শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি করে না। এ একমাস আমরা শুধু দীর্ঘ সময় শরীয়ত মানি না, সাথে সাথে অন্য সমযের তুলনায় বেশী বেশী বিধি নিষেধও মেনে চলি। অন্য সময় যে বিষয়গুলো হালাল, রামাদানের সময় দিনের বেলায় সেগুলোও হারাম করে দেয়া হয়। আবার রামাদানে দিনে-রাতে যে বিষয়গুলোহালাল তারও কিছু কিছু এতেকাফরত ব্যক্তির জন্য হারাম করে দেয়া হয়। যাতে করে দীর্ঘ সময় ধরে অন্য সময়ের তুলনায় বেশী বেশী বিধি-নিষেধ চর্চা করে মানুষের মধ্যে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ তথা শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। আর এ কঠোর প্রশিক্ষণ জীবনে মাত্র একবার নয় বরং ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর আসে। এ ভাবে জীবনের প্রতিটি বছরে দীর্ঘ এক মাস ধরে মানুষের মধ্যে শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি করা হয়। যাতে করে সে বছরের বাকী এগার মাস তাকওয়ার অন্যতম উপাদান শরীয়ত মানার অভ্যাস রপ্ত করতে পারে। মানুষকে শরীয়ত মানতে সাধারণত: তার নাফসের খায়েশাতই প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর এ নাফসের খায়েশাত প্রধানত: পানাহারের চাহিদা, যৌনাচারে চাহিদা, আরামপ্রিয়তা, কৃপণতা ইত্যাদি রুপে আত্মপ্রকাশ করে থাকে।রামাদান মাসে দীর্ঘ সময় ধরে দিনের বেলায় হালাল-হারাম সকল খাদ্য-পানীয় বর্জন এবং রাতের বেলায় পরিমিত খাদ্য-পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে খাদ্য-পানীয় গ্রহণের বিষয়ে মানুষের মধ্যে শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি করা হয়। দিনের বেলায় বৈধ যৌনাচার স্বীকৃত। কিন্তু রামাদানে দিনের বেলায় তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। যাতে করে দীর্ঘ এক মাসের প্রশিক্ষণের ফলে বাকী এগার মাসমানুষ অন্তত: অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত থাকতে পারে। অতিরিক্ত অলসতা-আরামপ্রিয়তা দুনিয়ায় যেকোন ভাল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা। এ জন্য মহানবী (সা.) আমাদেরকে এভাবে দোয়া করতে শিখিয়েছেন -“হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, বার্ধক্য ও কৃপণতা থেকে (বুখারী-৬৩৬৭, মুসলিম-২৭০৬)।” রামাদান আমাদেরকে এ আরামপ্রিয়তা ও অলসতা বর্জনের শিক্ষা দেয়। চিন্তা করুন, ভোর বেলা আরামের ঘুম ত্যাগ করে উঠে সেহরী খেতে হয়। পারলে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে বলা হয়। ঢুলু ঢুলু চোখে সেহরী শেষ করে মন যখন ঘুমাতে চায় তখন বলা হয়, না ঘুমাতে পারবে না মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়। সারাদিন কষ্ট করে রোজা রেখে ইফতারের পর মন যখন একটু আরাম করতে চায় তখন বলা হয়, উঠো এবং অন্য সময়ের চেয়ে আরও দীর্ঘ নামাজ পড়। অবশেষে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বিছানায় যাওয়া হয় তখন বলা হয়, অন্য সময়ের মত ইচ্ছামত ঘুমাতে পারবে না, উঠো সেহরী খাও। এভাবে একদিন নয়, প্রতি বছর দীর্ঘ এক মাস করে ট্রেনিং দিয়ে মানুষকে বাকী এগার মাস অলসতা-আরামপ্রিয়তার মোকাবেলায় শরীয়ত মানতে অভ্যস্ত করা হয়। অর্থলিপ্সুতা ও কৃপণতা নাফসের আরেকটা খায়েশাত। রামাদান আমাদের দানশীল হতে শিখায়। হাদীসে আছে, রাসুল সা. সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রমজান মাসে যখন জিবরীল (আ.) তাঁর সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন (বুখারী-৩০৪৮)। এ ছাড়া সাদকাতুল ফিতর আমাদের জন্য ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। অন্যকে ইফতার করানোর প্রচুর ফজিলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে নাফসের কৃপণতা খায়েশকে দমন করে বাকী এগারটি মাস মুত্তাকীর অন্যতম গূণ দানশীল হতে রামাদান আমাদের শিক্ষা দেয়।
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা দয়া করে কুরআন নাযিলের মাস রামাদানে কুরআন মেনে চলার অন্যতম শর্ত তাকওয়া অর্জনের জন্য কী চমৎকার ব্যবস্থাই না করে রেখেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অন্যান্য ইবাদতের মত রামাদানকেও আমরা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছি। প্রত্যেক ইবাদত এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর ফরজ করেছেন। আমাদের বিবেচনা করতে হবে, যে ইবাদত যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর ফরজ করেছেন আমরা তা হাসিল করতে পারছি কিনা। অথবা একটি ইবাদত আমার মাঝে যে অবস্থার সৃষ্টি করতে চায় ঐ ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে আমার মধ্যে সে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে কিনা। এটিই হচ্ছে ইহতে সাব। এ জন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যে লোক রমজান মাসের রোজা রাখবে ঈমান ও ইহতেসাব সহকারে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (বুখারি-২০১৪, মুসলিম-১৮১৭)। অর্থাৎ রামাদান আমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে চায় আমরা যদি তা হাসিল করতে পারি তাহলেই আমরা রামাদানের পুরো ফায়দা অর্জন করতে পারবো। এজন্য নবীজী (সা.) অন্য হাদীসে বলেছেন, যে লোক মিথ্যা কথা এবং তদনুযায়ী আমল করা ও মুর্খতা পরিত্যাগ করল না তার খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী-১৯০৩)। ইসলাম ব্যতীত বাকী সব কথা, কাজই মুর্খতা ও মিথ্যা। সুতরাং সিয়াম সাধনার পর কেউ যদি তাকওয়ার গুণকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে না পারে যাতে সে ইসলাম ছাড়া আর বাকী সব মিথ্যা কাজ, কথা, মুর্খতা ত্যাগ করতে পারল তাহলে তার এ সিয়ামে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। এ কথাই পেয়ারা হাবীব (সা.) অন্য হাদীসে বলেছেন এভাবে, এমন বহু রোজাদার রয়েছে যার রোজা ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। আর নামায পড়ুয়াদের মধ্যেও এমন অনেক রয়েছে যাদের তারাবীহ থেকে বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না (আহমদ -৯০৯১, দারামী-২৭২০)।
আসুন! রামাদানকে আমরা তাকওয়া অর্জনের মাস হিসেবে নেই। চেষ্টা করি মুত্তাকী হতে। শুধু রামাদানে নয় সারা বছর কাজে লাগাই এ তাকওয়াকে। আর এর মধ্যই রয়েছে আমাদের সিয়াম সাধনার সার্থকতা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন! আমীন!!
লেখক: উপ- পরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিলেট। (সমাপ্ত)