মোঃ ফখরুল ইসলাম
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা রাহমানুর রাহীম পরম করুণাময় অশেষ দয়ালু। তাঁর দয়ায় আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা, আর তাঁর দয়ার উপরই নির্ভর করছে আমাদের শেষ পরিণতি। কখনও কি ভেবে দেখেছেন আমাদের উপর আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় দয়া কোনটি? কালামে পাকে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন “শপথ মানব প্রকৃতির এবং যিনি তার যথাযথ বিন্যাস স্থাপন করেছেন- তাঁর। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাকে তার পাপ ও (পাপ থেকে) বেঁচে থাকার (বিশেষ জ্ঞান) প্রদান করেছেন (৯১:শামস:৭-৮)।”** অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা জন্মগতভাবেই মানুষের সত্ত্বায় কোনটি ভাল ও কোনটি মন্দ সে জ্ঞান এবং মন্দ থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষ জ্ঞান এলহাম করে দিয়েছেন। এখন একবার চোখ বন্ধ করে চিন্তা করুন, আল্লাহতায়ালা যদি আমাদের বলতেন আমি তোমাদের ভালো-মন্দ বুঝে চলার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়েছি। সুতরাং যাও – এখন দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলাম, নিজ যোগ্যতায় ভাল-মন্দ বাছাই করে চলো। তাহলে কী খুব বেইনসাফী হতো?তখন আমাদের অবস্থা কী হতো? আমরাতো অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরতাম। কিন্তু দয়াময় আল্লাহতায়ালা তা করেননি। তিনি আমাদেরকে ভালো-মন্দ বুঝার ক্ষমতা দেয়ার সাথে সাথে ভালো-মন্দ কোনটি তাও বাতলে দিয়েছেন। আর সেটিই হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আর সেজন্যই মহাগ্রন্থ আল কুরআনই হচ্ছে আমাদের প্রতি আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় রহমত, নেয়ামত, দয়া। এজন্যই আল কুরআনের বহুল পঠিত সুরা আর রহমানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “পরম করুণাময় (আল্লাহ তায়ালা), তিনি (তোমাদের) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (৫৫:আর রাহমান:১-২)”। আরেক বহুল পঠিত সুরা সুরা ইয়াসিন এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “পরাক্রমশালী পরম দয়ালু (আল্লাহ তায়ালা) এঁর কাছ থেকেই এ (কুরআনের) অবতরণ (৩৬: ইয়াসিন: ৫)”। এ দুটি আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা কুরআন নাযিল ও শিক্ষাদানের সাথে তার “রহমান” নাম ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ আমাদেরকে কুরআন দেয়া এবং তা শিক্ষাদানের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করাই হচ্ছে আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় দয়া।
পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, একক ইবাদত হিসেবে রামাদানের যত ফজিলত ও মর্যাদা কুরআন- হাদীসে বর্ণিত হয়েছে অন্য ইবাদতের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কিন্তু এই যে, রামাদানের এত ফজিলত ও মর্যাদা তা কি শুধু রামাদানের নিজের জন্য? তা কিন্তু নয়। বরং রামাদান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে বলেই রামাদান মাসের এত মর্যাদা। আল্লাহ তায়ালার ভাষায়, “রোজার মাস (এমন একটি মাস) যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, আর এ (কুরআন হচ্ছে) মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী, অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (এ) মাসটি পাবে, সে এতে রোজা রাখবে (২: সূরা বাকারা: ১৮৫)”। এ আয়াতের মর্মানুযায়ী আমরা বুঝতে পারি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে বলেই যারা এ মাস পাবে তাদের এ মাসে রোজা রাখতে বলা হয়েছে। শুধু কি তাই? ভেবে দেখুন, কুরআন যে রাতে নাযিল হয়েছে আল্লাহ তায়ালা সে রাতকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা দিয়েছেন (৯৭: ক্বদর: ১-৫)। কুরআন যে ব্যক্তির উপর নাযিল হয়েছে সেই মুহাম্মদ (সা.) সৃষ্টির সেরা। কুরআন সে শহর সমূহে নাযিল হয়েছে সেই মক্কা-মদীনাকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত হারাম বা সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। কুরআন যে মানে সে সম্মানিত ফেরেস্তাদের সান্নিধ্য লাভ করে (বুখারী-৪৯৩৭, মুসলিম-৭৯৮), আর যে মানে না সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায় (৭: আরাফ: ১৭৯)। এ কিতাবের মাধ্যম আল্লাহ বহু জাতির উত্থান ঘটান, আবার এ কিতাবের মাধ্যমে বহু জাতির পতন ঘটান (মুসলিম)। এ কুরআন যে শিখে, আর যে শিখায় উভয়ই সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম হয়ে যায় (বুখারী-৫০২৭)। যে মাহফিলে এ গ্রন্থের আলোচনা হয়, তা রহমত ও অনুগ্রহ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় (মুসলিম-২৬৯৯)। যে কুরআনের এত মর্যাদা ও মাহাত্ম্য, সে কুরআন যদি আমাদেরকে রমজান মাসে উপহার দেয়া হয় তাহলে সে রমজান মাসের মর্যাদাইবা অতুলনীয় হবে না কেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে শ্রেষ্ঠ মাস রামাদানে আল্লাহ তায়ালা আমাদের তার শ্রেষ্ঠ দয়া ও সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল মহাগ্রন্থ আল কুরআন দান করলেন বিনিময়ে আমাদের কি কিছু করণীয় আছে? আল্লাহ তায়ালা নিজেই কুরআনুল মাজিদে এর জবাব দিয়েছেন এভাবে, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের (কুরআনের মাধ্যমে) যে পথ দেখিয়েছেন তার জন্য তোমরা তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করো (২ : সূরা বাকারা : ১৮৫)”। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের বলছেন এই যে আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ মাসে শ্রেষ্ঠ দয়া করলাম, তোমরা তার শুকরিয়া আদায় করো। আর এটা বোধ হয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই যে, আমরা কুরআন প্রাপ্তির শুকরিযা শুধু এভাবেই আদায় করতে পারি যে, আমরা এটা পড়বো, অনুধাবন করবো, নিজের জীবনে ও সমাজে এটা কায়েম করবো। কিন্তু আমরা কুরআন থেকে চাইলেই উপকৃত হতে পারবো না। তার জন্য আমাদের আবার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা এ গ্রন্থের শুরুতেই বলে দিয়েছেন যে, এ গ্রন্থ থেকে উপকৃত হতে হলে আগে তাকওয়া অর্জন করতে হবে (২: সূরা বাকারা: ২)। আল্লাহতায়ালা আমাদের উপর কত মেহেরবান দেখেন, কুরআন নাযিলের মাস রামাদানে তিনিই আবার আমাদের কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার শর্ত ‘তাকওয়া’ হাসিলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। রামাদান ফরযের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে পাকে তিনি বলেছেন,“আশা করা যায় তোমারা (এর মাধ্যমে) তাকওয়া অর্জন করতে পারবে (২: বাকারা: ১৮৩)”।
এখানেই রামাদান, কুরআন ও তাকওয়ার আন্ত:সম্পর্ক। রামাদান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে বলেই রামাদানের এত মর্যাদা। আবার এ রামাদান মাসেই কুরআন মানার জন্য অন্যতম শর্ত তাকওয়া হাসিলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কুরআন নাযিলের মাস রামাদানকে ব্যবহার করে আমরা তাকওয়া অর্জন করবো, আবার তাকওয়াকে ব্যবহার করে কুরআন মানবো, আর কুরআন মানার মাধ্যমে আমরা কুরআন প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করবো। মোদ্দাকথা, কুরআন নাযিলের মাস রামাদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা, আর তাকওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন মানা, আর কুরআন মানার মাধ্যমেই আমরা আল্লাহ তায়ালার দেয়া শ্রেষ্ঠ দয়া ও রহমত কুরআন প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতে পারবো।
এখন আমরা দেখবো তাকওয়া কী? আর রামাদান কীভাবে আমাদের তাকওয়া হাসিলেসাহায্য করে। তাকওয়া শব্দের অর্থ হলো বাঁচা, নিষ্কৃতি পাওয়া, মুক্তিলাভ ইত্যাদি। তাকওয়া আল কুরআনের একটি নিজস্ব পরিভাষা। জীবন চলার পথে মুমিন আল্লাহর অসন্ত্ুিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য যে চেষ্টা সাধনা করে, আল্লাহর কাছে শাস্তিযোগ্য কার্যক্রম থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার যে চেষ্টা চালায়, তাই তাকওয়া। অর্থাৎ তাকওয়া হচ্ছে দেহ ও মনের এমন একটি অবস্থা যা মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) একবার উবাই ইবনে কাব (রা.) কে তাকওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উবাই (রা.) বলেছিলেন, আপনি কি কখনও কাটাযুক্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটেছেন? উমর (রা.) বলেছেন হ্যাঁ, তা তো হেঁটেছি। উবাই (রা.) তখন জানতে চাইলেন, কি করে আপনি সে রাস্তাটা অতিক্রম করেছিলেন? উমর (রা.) বললেন, আমি জামার হাত গুটিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে পরিশ্রম করে রাস্তাটা পার হয়েছিলাম। তখন উবাই (রা.) বললেন, এটাই হল তাকওয়া। সকল প্রকার গুনাহ থেকে নিজেকে সর্বদা এভাবে বাঁচিয়ে চলা এবং অক্ষত (নিষ্পাপ) অবস্থায় দুনিয়ার জীবনটা শেষ করতে পারাটাই তাকওয়া। এ তাকওয়ার প্রধান উৎস হচ্ছে দুটি। এক- ঈমান বিল্লাহ, দুই- ঈমান বিল আখিরাত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন আমীরুল মু‘মিনীন হযরত ওমর (রা.) এর সাথে একদিন মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে পথে বিশ্রাম নেয়ার সময় একজন বকরী রাখালের সাথে দেখা হল। রাখালটি পাহাড়ে বকরী চড়াচ্ছিল। হযরত ওমর (রা.) রাখালকে বললেন, আমাদের কাছে একটি বকরী বিক্রি কর। রাখাল উত্তরে বলল, সে তো মালিকের চাকর মাত্র সে কি করে বিক্রি করবে। তখন ওমর (রা.) বললেন, তোমার মালিককে বলবে, একটা বকরী বাঘ খেয়ে ফেলেছে। তখন চাকরটি বলল, আল্লাহ কোথায়? সাথে সাথেই ওমর (রা.) কেদে ফেললেন। অতঃপর ঐ চাকরের মালিকের কাছে গিয়ে তার কাছ থেকে চাকরটাকে খরিদ করে নিয়ে আযাদ করে দিলেন (মিনহাজুল মুসলিম)। আরেকটি ঘটনা -হযরত ওমর (রা.) তাঁর খেলাফতের সময় দুধে পানি মিশানো নিষেধ করে একটি আদেশ জারী করেছিলেন। এক রাতে তিনি মদিনার অলি গলি ঘুরে দেখতে বের হলেন। তখন একটি স্ত্রী লোক তার মেয়েকে বলছিল সকাল হয়ে গেল তুমি দুধে পানি মিশাওনি কেন? বালিকাটি উত্তর দিল আমি কিভাবে দুধে পানি মেশাবো? খলিফা ওমর (রা.) যে দুধে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন। মা বলল, লোকে পানি মেশায় তুমিও মিশিয়ে নাও। খলিফা কিভাবে জানবেন। বালিকা বলল, ওমর (রা.) না জানলেও ওমরের (রা.) আল্লাহর নিকটতো এটা গোপন থাকবে না। এ দুটি ঘটনা পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাই এ দুটি ক্ষেত্রে বালক ও বালিকাটির ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাত দৃঢ় ছিল বলেই অন্য কারো ভয়ে নয় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভয়েই তারা সবার অগোচরেও মন্দ কাজ করেনি। অর্থাৎ যার ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাত যত দৃঢ় হবে তার মধ্যে তাকওয়া ততবেশী পাওয়া যাবে। (অসমাপ্ত)