তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি ॥ দূতাবাস কর্মকর্তারা এখনো জানেন না মারা যাওয়া আর জীবিত বাংলাদেশীদের হিসাব

25

কাজিরবাজার ডেস্ক :
তিউনিসিয়ায় নৌকা ডুবিতে ৩৭ বাংলাদেশীর পরিচয় শনাক্ত করার জন্য লিবিয়া থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা অকুস্থলে গেছেন। তারা মৃতদের বিষয় নিয়ে তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছন। তারা এখনও জানতে পারেননি এ ঘটনায় কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন। জীবিতদের বিষয়েও তারা কিছু বলতে পারেননি। দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সেকান্দার আলী ও শ্রম উইয়িংয়ের কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হতে আরও দু’একদিন সময় লাগবে।
মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, নৌকাডুবির ঘটনায় বাংলাদেশীদের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন তথ্যমতে ৩৭ বাংলাদেশী মারা গেছেন বলে আমরা শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এ ধরনের কোন তথ্য নেই। আমাদের দূত সেখানে গেছেন। পরখ করার পর তারা বাঙালি হলে অবশ্যই তাদের লাশ দেশে আনা হবে। পাশাপাশি সরকার সেখানে আহতদের বিষয়েও ভাবছে।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইয়িংযের কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম টেলিফোনে জানান, আমরা তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি। তারা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বাংলাদেশীর পাসপোর্ট বা কোন ধরনের পরিচয় তুলে ধরেননি। আমরা এখানে কোন লাশও দেখতে পাইনি। এমন কি যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে দু’এক দিনের মধ্যে সব বিষয় খোলাসা হবে। ইতোমধ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, গত ১০ মে শুক্রবার ভূমধ্যসাগরে ওই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নৌকাডুবির পর তিউনিসিয়ার জেলে ও নৌবাহিনী ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার অভিযান মঙ্গলবারও চালিয়ে যাচ্ছে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী। ছোট একটি বৃহস্পতিবার লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে অন্তত ৭৫ জন রওনা দিয়েছিলেন ইতালির উদ্দেশে। গভীর সাগরে পৌঁছানোর পর বড় নৌকা থেকে তাদেরকে ছোট একটি নৌকায় তোলা হয়। ছোট্ট সেই নৌকাটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী ও মৎস্যজীবীরা ১৬ জনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। তাদের মধ্যে ১৪ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা বলছেন, নৌকাটিতে অন্তত ৫১ বাংলাদেশী ছিলেন। আর ছিলেন তিনজন মিসরীয় এবং মরক্কো, সাদ ও আফ্রিকার কয়েকজন নাগরিক। এই হিসাব থেকে অনুমান করা হচ্ছে, অন্তত ৩৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। তিউনিসিয়ার নৌকাডুবির ঘটনার বিষয়ে রেড ক্রিসেন্টের পারিবারিক যোগাযোগ পুনর্¯’াপন বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার সাইয়্যেদা আবিদা ফারহীন বলছেন, নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ধারণার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংঘাতময় লিবিয়ার জুয়ারা থেকে অবৈধভাবে ইতালিতে যেতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রওনা হয়েছিলেন ওই নৌযাত্রীরা। ভোররাতে তিউনিসিয়া উপকূলে আরেকটি ছোট নৌকায় তাদের ওঠানোর পর যাত্রীর ভারে তা ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার জেলেরা সাগর থেকে ১৬ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন, তাদের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশী। চারজন বাংলাদেশী এখন তিউনিসিয়ার জারজিস শহরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তারা ওই ১৪ জনের মধ্যে কি না- সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেননি।
তিউনিসিয়ার ঘটনায় ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেছেন, আমরা এ পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি ৩৭ বাংলাদেশ নৌকা ডুবিতে মারা গেছেন। তাদের পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশী ১৪ জন জীবিত উদ্ধার হওয়াদের বিষয়টি নিয়েও খোঁজ নেয়া হয়েছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মুহিদপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে আহমদ হোসেন, একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আবদুল আজিজ, মফিজুর রহমান সিরাজের ছেলে লিটন শিকদার, গোলাপগঞ্জের হাওরতলা গ্রামের রফিক মিয়ার ছেলে আফজাল মোহাম্মদ ও শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের ইয়াকুব আলীর ছেলে কামরান আহমদ মারুফ ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকসিমাইল গ্রামের আহসান হাবীব শামীমের নাম জানা গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বড় একটি নৌকায় রওনা হয়েছিলেন এই অবৈধ অভিবাসীরা। ওই নৌকায় অন্তত ৫১ বাংলাদেশী ছিলেন বলে বেঁচে যাওয়াদের তথ্য। বাকিদের মধ্যে তিনজন মিসরীয়, কয়েকজন মরক্কোর ও অন্যরা আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিক। তবে দেশটিতে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে এখনও আমরা কথা বলতে পারিনি। তারা সেখানে কি ধরনের অবস্থা দেখছেন তা জানা যায়নি।
ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এ্যাডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রেফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সিনিয়র গবেষক ও ইউল্যাবের অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেছেন, তিউনিসিয়ায় যারা মারা গেছেন তার দায় সরকার এড়াতে পারেন না। কারণ যারা মারা গেছেন তারা দেশের নাগরিক জীবিকার সন্ধানে যেভাবেই বিদেশে যাক না কেন তাদের লাশ ও জীবিতদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। জীবিতদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। তারা বর্তমানে ‘ট্রমা’তে অবস্থান করছেন। তাদের যে অবস্থায় আছেন তাদের সুস্থ না করা গেলে তারা একই ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তাই তাদের ভালমতো কাউন্সিলিং করতে হবে।
ভূমধ্যসাগরে ৫ ঘণ্টা সাঁতার কেটেও বাঁচতে পারেননি শামীম : ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবির পর বেঁচেছিলেন আহসান হাবিব শামীম। কয়েকজনের সঙ্গে একটি বয়া ধরে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সাঁতার কাটেন তিনি। কিন্তু এতক্ষণ সাঁতারের পর ক্লান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন শামীম। আরও কয়েকজনের মতো বয়া থেকে হাত ফসকে ডুবে যান তিনি। তীরে উঠে সহযাত্রী মাছুম অন্যদের এই তথ্য জানান। এই খবরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের বাদেভুকশিমইল গ্রামে শামীমের বাড়িতে এখন শোকের মাতম। তার লাশ কখন বাড়িতে আসবে সেই অপেক্ষায় রয়েছেন পরিবার ও গ্রামবাসী।
আহসান হাবিব শামীম বাদেভুকশিমইল গ্রামের মৃত হাফিজ আব্দুল খালিকের ছেলে। তিনি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই। ভাইদের মধ্যে দুই ভাই ফ্রান্স ও তিন ভাই থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। বড় ভাই হাজী আবু সাইদ বাচ্চু সৌদি আরবে থাকলেও এখন দেশের বাড়িতে আছেন।
আবু সাইদ বাচ্চু জানান, ‘শামীম ছিল কোরানে হাফেজ। সিলেট গোটাটিকরে একটি মাদ্রাসায় পড়ছিল সে। গত বছর তার দাখিল পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। তার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাড়ির কেউ জানত না। পরিবারের কোন সদস্যকে না জানিয়ে শামীম লিবিয়া চলে যায়। লিবিয়া থেকে তালতো ভাই সিলেটের গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ কদুপুরের মাছুম আহমদ ও মারুফ আহমদসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে নৌকায় ওঠে ইতালি হয়ে ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য। ফ্রান্সে আমাদের দুই ভাই সেলিম ও সুমনের কাছে যেতে চেয়েছিল তারা। ভূমধ্যসাগরের তিউনিশিয়া উপকূলে নৌকাডুবি হলে সাগরের পানিতে এই তিনজন একটি বয়ায় দীর্ঘ প্রায় ৫ ঘণ্টা সাঁতার কাটে। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে বয়া থেকে হাত ফসকে পড়ে শামীম ও মারুফ সাগরে নিখোঁজ হয়। মাছুমসহ আরও কয়েকজন বেঁচে যায়। বেঁচে যাওয়া মাছুম আহমদ ও নিখোঁজ মারুফ আহমদ আপন ভাই।’ তিনি আরও জানান, গত ৭ মে মা রাজনা বেগমের কাছে ফোন করেছিল শামীম। জানিয়েছিল পরদিন ৮ মে ফ্রান্সের উদ্দেশে রওনা দেবে। এরপর থেকে শামীমের আর কোন যোগাযোগ হয়নি পরিবারের সঙ্গে।
নিখোঁজ শামীমের বড় ভাইয়ের ছেলে কামরান হোসেন ও মেয়ে ফারজানা ইসলাম দিপা, নাহিদ কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘ছোট চাচা খুবই প্রিয়। তিন মাস আগে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে যান। আমাদের প্রিয় বাইসাইকেলটি বিকেল বেলায় আর কখনই চালাবেন না চাচা। কষ্ট হচ্ছে।’ পরিবারের সদস্যরা দ্রুত শামীমের লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আবেদন জানান।