ধানেরে ন্যায্য মূল্যে না পাওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার হাওর পারের কৃষকদের দুশ্চিন্তা !

102
হাওরপারের কৃষকরা ধান শুকাচ্ছেন।

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
অনুকূল আবহাওয়া ও পোকা মাকড় আক্রমণ না থাকায় মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওযায় কৃষকরা জমি থেকে ধান হাসিমুখে ঘরে তুলেছেন।
গত কয়েক বছর পুরোপুরি মাঠ থেকে কৃষকরা বোরো ধান উঠাতে না পারলেও চলতি বছর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষকরা বোরো ফসল ঘরে উঠাতে পেরেছেন।
এবার প্রতি বিঘায় ধানের ফলন ১৬ থেকে ২০ মণ হওয়ায় বেজায় খুশি কৃষকরা। তবে কৃষকের সেই স্বপ্নের ধান মাঠ থেকে ঘরে তুললেও ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠবে কিভাবে। জেলার কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এখন তারা দুচিন্তার মধ্যে আছেন।
কুলাউড়ার ভুকশিমইল ইউনিয়নের মুক্তাজিপুর গ্রামের কৃষক কুটি মিয়া বলেন, আমরা গরীব মানুষ প্রতি বছর কৃষি কাজ করে জীবিকা অর্জন করে থাকি। আল্লাহর রহমতে ধানের ফলনও ভাল হয়েছে। ৫০০ টাকা ধানের মণ, কাজের মানুষের রোজ ৫০০ টাকা, তিন বেলা খাওয়াতে হয়। ৫০০ টাকা মণ দরে ২৪ মন বোরো ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেছি। কিছু ধান রেখেছি নিজের খাওয়ার জন্য তাও পুরো বছর যাবে না। কয়েক বছর থেকে অপেক্ষায় আছি ধানের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ধান বিক্রি করে লাভবান হবো। কিন্তু তাও দেখছিনা। সন্তানদের লেখাপড়া ঠিক মতো করাতে পারিনা। অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক টাকাও লাগে। ক্ষেতের ধান বিক্রি করে খরচও উঠে না। এ অবস্থা থাকলে জমিতে আর ধান লাগাতে যাবো না।’
হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের মহিষঘরি গ্রামের কৃষক আনফর আলী বলেন, আমরা যারা কৃষক আছি এ নিয়ে সরকার কোন চিন্তা করে না। সরকারের চিন্তা থাকলে সরকার আমাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ও চাল ক্রয় করতো। ধানের ন্যায্য মূল্যও দিতেন। আমরাতো হাওর পারের মানুষের জীবন জীবিকা বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। একই কথা জানালেন,মুক্তাজিপুর গ্রামের কৃষক হারিছ মিয়া, ফয়ছল আহমদ ও গৌড়করন গ্রামের লেচু মিয়া।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বলেন, চলতি বছর বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫৩ হাজার ১৬২ হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল। উৎপাদন ভাল হয়েছে। কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে পারছে। কর্তনের সময় একসাথে অনেক ধান মাঠ থেকে সংগ্রহ করেন কৃষকরা। তাই ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু দিন মজুদ রেখে বিক্রি করলে মূল্য কিছুটা বেশী পাওয়া যাবে।’
তালিমপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা হাওরের কৃষক তাহির আলী, মিন্নত মিয়া ও ছাদ উদ্দিন বলেন, ‘জমি পরিষ্কার ও চারা রোপণ করতে প্রতিদিন একবেলা খাবার ও ৫০০ টাকা করে রোজ দিতে হয়েছে।
হাকালুকিতে হাওরে একযোগে বোরো আবাদ শুরু হওয়ায়, শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। তাই বেশি দামে শ্রমিক দিয়ে জমিতে ধান রোপণ করতে হয়েছে। তারা আরও বলেন, আগাছা পরিষ্কার করতে একই দামে শ্রমিক নিতে হয়েছে। এছাড়াও জমিতে সার, কীটনাশক দিয়েছি। এজন্য ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ধান বিক্রি করতে এখন ন্যায্য দাম পাচ্ছি না।’
জেলার রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘী হাওর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাইক্কাবিল হাইল হাওর এলাকায় শ্রমিক সংকট থাকায় বেশি দামে কৃষক শ্রমিক দিয়ে ধান কর্তন ও ধান রোপন করতে গিয়ে অনেক খরচ হয়েছে। যার ফলে কৃষকরা ধান বিক্রির সময় ন্যায্য দাম পাচ্ছি না বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার রুপুসপুর এলাকার বাসিন্দা কৃষক আবুল কালাম জানান, ‘১২০ শতক জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি, ধানের ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু ধান চাষ করতে সব মিলিয়ে আমার খরচ হয়েছে ২০/২৫ হাজার টাকা। ধান পেয়েছি ৭০ মণ। ধানের মণ ৫০০ টাকা। আমার এতো টাকা খরচ করে লাভ কি হল, নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি !। এখন যদি সরকার ধানের মণ ৮০০ টাকা করা হতো তাহলে মনকে বুঝ দিতে পারতাম।’
মৌলভীবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিনয় কুমার দেব জানান মৌলভীবাজার জেলায় সরকারী ভাবে ১ হাজার ৪শ ৫৫ টন ধান ও ৭ হাজার ৭শ ৭ মেট্রিক টন চাল ক্রয় করা হবে। ক্রয় সংক্রান্ত এই বরাদ্দের নির্দেশনা ২৭ এপ্রিলে তাদের হস্তগত হয়েছে। ইতোমধ্যে কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় মিলারের মাধ্যমে চাল ক্রয় শুরু হয়েছে।
হাওর বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও ও কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সিরাজ উদ্দিন আহমেদ বাদশাহ বলেন, এ মৌসুমে সরকার সাড়ে এগারো লক্ষ টন চাল এবং দেড় লক্ষ টন ধান ক্রয় করবে। সরকার প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা কেজি দরেক্রয়, সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা কেজি দরে ও ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল ক্রয় করার সিন্ধান্ত নিয়েছে। সরকারী ভাবে ধান ক্রয় বিক্রয় কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ ও বরাদ্দ না থাকায় এ জেলার কৃষকরা মণ প্রতি ধান বিক্রি করছেন ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। সরকার মিল মালিকগণকে বাচাঁতে মরিয়া উঠেছেন। অথচ ওই মিল মালিকরা ধান চাষ করেন না। তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান ক্রয় করে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রি করেন। এতে কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার কৌশলে ওই সবগুলোই ধান চাল মূলত মিল মালিকের কাছ থেকে কিনতে চান। এই ঘোষণা শুধুমাত্র লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না। কৃষক বাঁচাতে সরকারের সদয় হওয়া উচিত।’