কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিল্পের বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে দেশ-বিদেশে বাজার সৃষ্টির জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের পরও ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কেন কমছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমি মনে করি আমাদের দেশে শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকের ব্যাপারটা আমরা দেখছি। কয়েকদিন আগে আমরা বসেছিলাম, কিভাবে ব্যাংকের সুদের হার কমানো যায়। এ বিষয়ে আমরা আবার বসব, কিভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যায়।
রাজধানীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রবিবার দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী ‘জাতীয় শিল্পমেলা-২০১৯’-এর উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের শিল্প বহুমুখী করতে হবে। শিল্পোদ্যোক্তাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদেরও এখন চিন্তা করতে হবে নতুনভাবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা কিভাবে শিল্পায়ন ঘটাতে পারি।
ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো প্রসঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার এটাও অনুরোধ থাকবে যারাই এই ঋণটা নেবেন আপনারাও যদি টাকাটা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন বা সুদটা পরিশোধ করেন তাহলে ব্যাংকগুলো সচল থাকে। তখন কিন্তু সুদের হার কমানোটা খুব একটা কঠিন হবে না। তবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না দেয়া আরেকটা প্রবণতা। এই প্রবণতাটাও দূর করতে হবে।
ঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি। একবার উদ্যোগ নিলাম সঙ্গে সঙ্গে কথাও বললাম। বেশকিছু সুযোগ-সুবিধাও দিলাম। যেমন আগে আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারী ব্যাংকে আর ৩০ ভাগ অর্থ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা হতো। ব্যাংকের মালিকরা বললেন, এটা যদি ফিফটি ফিফটি করে দেয়া হয় তাহলে আমরা (সুদের হার) সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব। সেটাও কিন্তু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম এবং দিলাম। কিছু ব্যাংক ঠিকই সুদের হার ৯ পার্সেন্টে নামালো। কিন্তু সকলে তা করল না। বাড়াতে বাড়াতে ১৪, ১৫, ১৬ তে নিয়ে গেল। কেন করল না তাদের এই সুযোগটা দেয়া সত্ত্বেও?
সরকার প্রধান বলেন, এখন আমার এখানে প্রশ্ন আছে, এই ব্যাংকের মালিক যারা তাদেরও তো শিল্প কলকারখানা আছে। তারাও তো ব্যবসা-বাণিজ্য করে। এখন আমাকে তো সেই জায়গাটায় আগে হাত দিতে হবে। তারা সবাই ট্যাক্সটা ঠিকমতো দিচ্ছে কিনা, ভ্যাট ঠিকমতো দিচ্ছে কিনা, কাঁচামাল ঠিকমতো আছে কিনা। তিনি বলেন, শুধু সরকারই সব করে দেবে তা তো না। আমরা তো বেসরকারী খাতকে সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। বেসরকারী খাতকে কিন্তু আমাদের সংবিধানেই স্বীকৃতি দেয়া আছে। আমি সরকারে আসার পর বেসরকারী খাতটা সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত করে দিয়েছি।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের একটা সার্বিক হিসাব আছে দেশে ৭০ লাখের মতো শিল্প কারখানা বেসরকারী খাতে আছে। প্রতিবছর সেখানে যদি একটা মানুষ কাজের সুযোগ পায় তাহলে ৭০ লাখ লোক তো কাজ পেল। তারপরও কেন আমাদের হচ্ছে না সেটা হলো কথা। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না দেয়া আরেকটা প্রবণতা। এই প্রবণতাটাও দূর করতে হবে। ব্যাংকের যে টাকা, এ টাকার মালিক তো জনগণ। বেসরকারী খাতে আমরা ব্যাংকভাবে ব্যাংক করার সুযোগ করে দিয়েছি। আমার সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক-বীমা করার সুযোগ-সুবিধা আমরা করে দিয়েছি। ব্যাংক শুধু দিলেই হবে না। মানুষের মধ্যে ব্যাংক ব্যবহারের একটা প্রবণতাও তৈরি করতে হবে। সেটাও আমরা করে দিয়েছি।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইমার্জেন্সি টাইমেও অনেকেই ভুক্তভোগী। অনেক ব্যবসায়ীকে কষ্ট পেতে হয়েছে আমি জানি। কেউ জেলে গেছেন, কেউ দেশছাড়া। কারও ব্যবসা-বাণিজ্য, কারও শিল্প বন্ধ প্রায় দুই বছর পর্যন্ত। তাদের জন্য আমরা এরই মধ্যে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। তাদের জন্য আমরা ইতোমধ্যে বিশেষভাবে প্রণোদনা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও দেখা হবে। আমরা চাই ব্যবসায়ীরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ভালভাবে করতে পারে শিল্পায়নটা আরও দ্রুত যেন হয়।
দেশের জনগণকে মেধাবী আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি এবং রফতানির ক্ষেত্রে আমরা এই মেধাকে কাজে লাগাতে পারি। কেবল একটা নিয়ে পড়ে থাকা নয়, আমাদের শিল্পায়ন, উৎপাদন, রফতানি এবং বাজারজাতকরণকে বহুমুখী করতে হবে। আমাদের রফতানির বাস্কেট বাড়াতে হবে। আর সেটা বাড়াতে গেলে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার শিল্পায়ন। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশে যে বিশাল তরুণ সমাজ রয়েছে তাদের সবার কর্মসংস্থান করাই এর মূল লক্ষ্য উল্লেখ করে এজন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের বেলায় আমাদের মেয়েরা খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাদের একটু সুযোগ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলে তারা অনেক কিছুই ঘরে বসেই তৈরি করতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের তরুণ সমাজকে ও নারী সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে দেশেও যেমন শিল্পায়ন করতে হবে আবার কৃষি পণ্যও থাকবে। আমাদের দেশে এমন বহু পণ্য রয়েছে যেগুলো আমরা উৎপাদন করে বাজারজাত করে শিল্পায়ন এবং কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটাতে পারি। তৃণমূল পর্যায়ে সকল নাগরিক সুবিধা প্রদান করে প্রতিটি গ্রামকে একটি শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর সরকার একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিল্পনীতি ঘোষণা করেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ধরে রেখে দেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর মতোই লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যখনই সরকার গঠন করেছি তখনই আমাদের আশু করণীয় কি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি এবং একটি যুগের পর আরেকটি যুগে কি কাজ করব সেটি নির্ধারণ করেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিল্পপতিদের উদ্দেশে দেশের বাজারকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনারা উৎপাদন করবেন, যদিও সবকিছুইতো আর রফতানি হবে না। নিজের দেশেও বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আর নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হলে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। আর তাহলেই পণ্য বিক্রি হবে। নিজের দেশে যেখানে ১৬ কোটি মানুষ সেখানে তো একটি বিরাট বাজার নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়ে আছে। শুধু এই বাজারটিতে আপনাদের ধরতে হবে। কাজেই শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকেও আপনাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
শিল্পকারখানার মালিকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে শিল্পায়ন ছাড়া কর্মসংস্থান সম্ভব হবে না। আমাদের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। কিন্তু এ কৃষিভিত্তিক শিল্প আমাদের দরকার। সে ক্ষেত্রে একদিকে যেমন আমাদের শিল্পায়ন প্রয়োজন, অপরদিকে আমাদের কৃষিপণ্য এবং খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার শিল্পের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিদেশে রফতানির জন্য নতুন নতুন বাজার খোঁজার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, তবে শিল্পায়ন করতে গিয়ে কৃষি জমি যেন নষ্ট না হয় সেদিকেও সবাইকে নজর দিতে হবে।
পণ্য রফতানিতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানি করতে চাই তাহলে কার্গো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ। এখন কার্গো ভাড়া করে চালানো হচ্ছে। বিমানকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, বিমানকে শুধু প্যাসেঞ্জার টেনে লাভজনক করা যাবে না। কার্গো আমাদের দরকার। কার্গো ভিলেজ আমাদের তৈরি করা দরকার। পণ্যগুলো যেন যথাযথভাবে, মানসম্মতভাবে সেখানে থাকে এবং ২৪ ঘণ্টার ভেতর পাঠিয়ে দিতে পারি বিদেশে, সে ধরনের ব্যবস্থাপনায় আমাদের যেতে হবে। আমাদের নিজস্ব কিছু থাকা দরকার, যাতে দেশের জন্য লাভজনক হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, যে অগ্রযাত্রা আমাদের শুরু হয়েছে, এটা যেন কোনমতে ব্যাহত না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আপনারা কাজ করবেন। শিল্পায়ন ছাড়া একটি দেশ যেমন উঠে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি কেবল শিল্প দিয়ে কারো পেট ভরে না। মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, আমরা আলু উৎপাদন করতে পারছি, সবজি উৎপাদনে আমরা চতুর্থ স্থানে রয়েছি, খাদ্য উৎপাদনে চতুর্থ। কাজেই এসব পণ্য বিদেশে রফতানির জন্য আমাদের আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের খাবার বন্দোবস্তাটাও তো আমাদের করতে হবে এবং এটা সকলকে খেয়াল করতে হবে। অনেক ঝড়-ঝঞ্জা এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে উপেক্ষা করেও বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি। দেশের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আব্দুল হালিম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, সংসদ সদসগণ, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা, বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা, দেশী ও বিদেশী উদ্যোক্তা এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডের ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদোগে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী এই জাতীয় শিল্পমেলায় সারাদেশের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির, হস্ত, কারু এবং উচ্চ প্রযুক্তি খাতের প্রায় ৩শ’ প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ মেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে- দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার, প্রসার, বিক্রয় ও বাজার সম্প্রসারণ এবং ছোট ও বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন, যোগাযোগ ও সেতুবন্ধ তৈরিতে সহায়তা করা। মেলায় মোট ৩শ’টি স্টল থাকবে। এসব স্টলে ১১৬ নারী এবং ১০৭ পুরুষ উদ্যোক্তা তাদের পণ্য প্রদর্শন করবে।