কাজিরবাজার ডেস্ক :
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে এলো ১৯৭১’র ২৫ মার্চ। দিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ২৫তম দিন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারী-বেসরকারী অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সর্বত্র শোকের কালো পতাকার পাশাপাশি আশাদীপ্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন। এদিন মানুষের ঢল নামে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২নম্বর বাসভবনে। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সারাদিন মাঝে মাঝে মিছিলের সামনে এসে তিনি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান। টালমাটাল মার্চের এদিন বাংলার বুকে নেমে আসে কালরাত, অত্যাচার, উৎপীড়ন, পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালো থাবা। সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও উভয় দলের উপদেষ্টার মধ্যে বৈঠক। বিকেলে পল্টন ময়দানে পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিশাল জনসভা। বিকেলেই সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু রংপুর, সৈয়দপুর, জয়দেবপুর ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতাল আহ্বান করেন। পাকহানাদার বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে রাত ১ টা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দেশব্যাপী পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। সামরিক ভাষায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত এই হত্যা অভিযান। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যান। রাত পৌনে আটটায় তিনি গোপনে বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পূর্ববাংলায় নিরপরাধ বাঙালীর ওপর কাপুরুষোচিত সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন- আমি শুধু বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়। বাঙালীর আবেগ, সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করতে অস্ত্র হাতে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠার নীলনকশা চূড়ান্ত করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে শুরু করে গণহত্যা। পাকহানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে। রাত ১ টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনানুযায়ী ২২ তম বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডে ১৮বাঙালী গার্ড থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। পিলখানা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় প্রচ- আক্রমণ। বিভিন্ন এলাকাতে যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন: পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এটাই হয়ত আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান। এর আগে সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এবং ইয়াহিয়া ও পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছেছিল। রাত ৯ টার পর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখ- পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন। পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়ারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। সারা দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সূচিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী নিধনের উদ্দেশে ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে, প্রায় একই সময় চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও বাঙালী সৈনিকবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ বিদ্রোহ শুরু করেন। আনুমানিক রাত ১১:৪৫ মিনিট হতে বাঙালী অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের বন্দী করতে শুরু করেন। অন্যান্যের সঙ্গে কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে বন্দী করে নিয়ে আসেন মেজর জিয়াউর রহমান। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে মধ্যরাতের নিকটবর্তী সময় চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের সূচনা হয়। ইপিআর এ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, পুলিশ বাহিনীর কর্ণধার এসপি এম শামসুল হক নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাত ১টায় পাকবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তার বাসভবন থেকে বন্দী করে শেরেবাংলা নগরে সামরিক বাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়।