॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশেরর পর)
সন্তানদেরকে সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা দেয়া দরকার। আর সেজন্য মা-বাবাকে অবশ্যই মিথ্যা পরিহার করতে হবে। বাচ্চাদের সাথে খেলাচ্ছলে বা ঠাট্টাস্বরেও মিথ্যা বলা যাবে না। কারণ ঠাট্টা মশকারী করেও মিথ্যা বলা জায়েয নয়। বাচ্চাদের সাথে কিছু দেয়ার জন্য ওয়াদা করলে অবশ্যই তা রক্ষা করতে হবে। তাই যা রক্ষা করা সম্ভব এমন ওয়াদা করাই উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, ‘‘কেউ যদি কোন বাচ্চাদের বলে- এসো নাও। তারপর বাচ্চা এলে তা দেয় না, এটাও একটা মিথ্যা বলা।’’ বাচ্চার দুষ্টুমি কমাতে বা ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে অনেক সময় মায়েরা অনেক মিথ্যা ভয় দেখান, হাদীসের দৃষ্টিতে এগুলোও মিথ্যার আওতায় পড়ে যায়। এগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে শিশুর মনে মিথ্যা বলার অভ্যাস পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা ভালো যে, যে কোন খারাপ কাজ থেকেই সন্তানদেরকে বিরত রাখতে হলে নিজেদেরকে অবশ্যই সে খারাপ কাজটা বর্জন করতে হবে। পিতামাতা অন্যদের সাথে মিথ্যা বলবে, আর সন্তান মিথ্যা বললে তাকে শাসন করবে আচ্ছা করে- এমনটি অনেকেই করে থাকেন। পিতা সন্তানদের সামনে যখন খুব করে ধুমপান করে, ছোটদের কাছে মনে হয় এমন কায়দা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লে কতোই না মজা লাগে। পিতা মাতার অজান্তে আস্তে করে একটা টান দিয়ে মজার কৌতুহল মেটাতে তার মনে ভীষণ আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনটি হতে দেখলে সন্তানকে বড় ধরনের শাস্তি দিতে অনেকেই বিলম্ব করেন না। কিন্তু পিতা কি লক্ষ্য করেছেন, আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ কি এ ব্যাপারে? “হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কথা কেনো বলো যা তোমরা করো না? এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই খারাপ যে, তোমরা এমন কথা বলো, যা তোমরা করোনা’’-(ছফ : ২-৩)
সম্ভব হলে পিতা ছেলেকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যাবেন। জামায়াতে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত করাবেন এবং ইসলামী আলোচনাম, ইল্ম এর আসরে বসতে অভ্যস্ত করে তুলবেন। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে নামাজে অভ্যস্ত করানো পিতামাতার একটি জরুরী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন, “তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর বয়স থেকেই নামাজের নির্দেশ দাও। দশ বছর বয়সে শাসন করে হলেও নামাজ পড়াতে হবে। আর তাদের বিছানা পৃথক করে দাও’’-(আবু দাউদ)। ছোটকাল থেকেই রোজার অভ্যাস করানো উচিত। সাহাবায়ে কেরাম তাদের সন্তানদেরকে বালেগ হওয়ার আগেই রোজার অভ্যাস করাতেন। মসজিদে টুকটাক খেলনাও নিয়ে যেতেন বাচ্চাদের জন্য। আসরের পর বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে গেলে, ওদের কষ্ট ভুলানোর জন্য খেলনা দিয়ে ব্যস্ত রাখতেন ইফতার পর্যন্ত-(বুখারী)। হারাম থেকে তাদেরকে সতর্ক করা দরকার। আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, একবার আলী (রা:)-এর পুত্র হাসান (রা:) একটি সাদাকার খেজুর মুখে দিয়ে ফেললে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, কীখ! কীখ! অর্থাৎ মুখ থেকে ফেলে দেয়ার জন্য। অত:পর তিনি বললেন, “তুমি কি জানো না যে, আমরা সাদাকার মাল খেতে পারিনা!’’-(বুখারী)।
তাদেরকে খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরার সুন্দর ইসলামী আদাবগুলো শিখানো উচিত। উমর বিন আবি সালামা (রা:) বর্ণনা করেন, আমার শৈশব কেটেছে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ঘরে। ছোট বয়সে সবার সাথে এক সঙ্গে বড় প্লেটে খেতে বসলে হাত প্লেটের সবখানে ঘোরাঘুরি করতো। রাসূল (সা:) আমাকে একদিন বললেন, “বৎস, বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া খাবে, ডান হাতে খাবে আর তোমার সম্মুখস্থ অংশ থেকে খাবে’’-(বুখারী ও মুসলিম)। হুযাইফা (রা:) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাথে কোথাও একই প্লেটে খেতে বসলে খাবারে হাত লাগাতাম না যতোক্ষণ না রাসূলুল্লাহ হাত লাগাতেন। একবার তাঁর সাথে আমরা খেতে বসেছি। হঠাৎ করে একটি ছোট্ট মেয়ে ছুটে এলো। মনে হলো যেনো কেউ তাকে ঠেলে দিয়েছে। খাবারে হাত ঢুকিয়ে দেবে ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা:) তার হাত ধরে ফেললেন। তারপরই হঠাৎ করে চলে আসলো আরেকজন বেদুঈন। তাকেও মনে হলো কেউ ঠেলে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) তার হাতও ধরে ফেললেন। অত:পর তিনি বললেন, ‘‘খাবার শুরুর পূর্বে কেউ বিসমিল্লাহ না বললে সে খাবারে শয়তানের সুযোগ হয়ে যায়। সে উদ্দেশ্যে শয়তান মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিলো কিন্তু আমি তার হাত ধরে ফেলেছি। পরে এই বেদুঈনটিকে নিয়ে এলো, আমি তারও হাত ধরে ফেলেছি। যে আল্লাহর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, মেয়েটির হাতের সাথে শয়তানের হাতও আমার হাতে ধরা আছে’’-(মুসলিম)। একবার দু’ব্যক্তি রাসূল (সা:) এর কাছে এসেছিলেন কোন বিষয়ে আলাপ করতে। তাদের মধ্যে যিনি বয়সে ছোট, তিনি কথা শুরু করে দিলে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, “বড়জনকে বলতে দাও’’-(বুখারী)। পিতামাতার উচিত এভাবে সন্তানদেরকে বড়দেরকে সম্মান করতে, ছোটদেরকে আদর-স্নেহ করতে, প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনের হক (অধিকার) ইত্যাদি আদাবগুলো শিখানো।
সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করা অতীব জরুরী। আম্বিয়ারে কেরাম ও পূর্বকালের নেক্কার লোকেরা এমনই করে বলতেন, “হে প্রভূ! আমার সন্তান-সন্ততিদেরকে নেক্কার বানিয়ে দিন’’-(আল আহকাফ:১৫) ‘‘রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াযিনা ওয়া জুররিইইয়াতিনা কুররাতা–’’ অর্থাৎ ‘‘হে প্রভূ! আমাদেরকে এমন স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি দান করুন। যারা আমাদের চক্ষু শীতল করে দেবে’’-(আল ফুরক্বান :৭৪) “হে প্রভূ! আমাকে নেক সন্তান-সন্ততি দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি দোয়া শ্রবণ করতে খুব বেশি পছন্দ করেন’’-(আল ইমরান)। “হে প্রভূ! আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে নামাজ কায়েমকারীদের অন্তর্ভূক্ত করুন’’-(ইবরাহীম :৪০)।
শয়তান ও বদ নযর থেকে ছোট সন্তানদের হেফাযতের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকা বড়ই কল্যাণকর। ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (সা:) মাঝে মধ্যেই হাসান এবং হোসাইন (রা:)কে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। তিনি বলতেন, ‘‘তোমাদের আদি পিতা ইব্রাহিম (আ:), ইসমাঈল (আ:) এবং ইসহাক (আ:) এ দোয়াটি পড়ে ফুঁ দিতেন। “উঈযুকুমা বি কালিমাতিল্লাহিততাম্মাহ্ মিন কুল্লি শায়তানিন ওয়া হাম্মাহ্ ওয়া মিন কুল্লি আইনিন্ লাম্মাহ্’’ অর্থাৎ: প্রত্যেক শয়তান ও বিষধর জীবজন্তু থেকে ও প্রত্যেক বদ নযরসম্পন্ন দৃষ্টি থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্য দ্বারা’’-(বুখারী)।
জাবের (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “যখন সন্ধ্যা ঘনীভূত হয়ে আসে তোমরা বাচ্চাদেরকে ঘরের ভেতর রেখো। কারণ ঐ সময়টিতে শয়তানগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা রাতের কিছু অংশ পার হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দিতে পারো। অত:পর রাতে দরজাগুলো বন্ধ করে দেবে বিসমিল্লাহ পড়ে কেননা শয়তান কোন বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। পান পাত্রটিও (পানির জগটিও) ঢেকে রেখো বিসমিল্লাহ পড়ে। সকল খাবারের পাত্রগুলোও ঢেকে রেখো বিসমিল্লাহ পড়ে। যে কোন কিছু দিয়ে হলেও অবশ্যই ঢেকে রেখো। আর তোমাদের বাতিগুলো নিভিয়ে দাও’’-(বুখারী ও মুসলিম)। নিজেদের গৃহ ও পরিবারকে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য উপরোক্ত হাদীসে অনেকগুলো আদাবের কথা বলা হয়েছে। যতেœর সাথে আমল করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সন্তান-সন্ততি তথা গোটা পরিবারকে শয়তানের অনেক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘যারা ঈমানদার হয়েছে এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে মিলিত করে দেবো। আর তাদের আমলকে (সৎ কর্মকে) বিন্দুমাত্রও হ্রাস করবো না’’-(তুর:২১)। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “আদম সন্তান যখন মৃত্যুবরণ করে তার সকল আমলের সমাপ্তি ঘটে যায় শুধুমাত্র তিনটি আমল ছাড়া। আর সেগুলো হচ্ছে: ১. সাদাকা জারিয়া, ২. এমন ইল্ম যা থেকে লোকেরা ফায়দা পেতে থাকে এবং ৩. নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে’’-(মুসলিম ও নাসায়ী)। এর বিপরীতে মানুষ তার প্রতি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সন্তান সন্ততিকে গড়ে তোলার এ আমানতের খেয়ানত করলে কাল ক্বিয়ামতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। শুধু তাদের দোয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া নয়, তাদের পথ ভ্রষ্টতার দায় দায়িত্বের অনেকাংশও এসে পড়বে তার উপর। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “একজন মানুষের এতটুকুন গুনাহই যথেষ্ট যে, সে তার উপর নির্ভরশীলদেরকে (সন্তানদেরকে) বরবাদ করে দেয়’’-(আবু দাউদ) আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইসলামীকরণ পরিবার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের আদবসমূহ পালন করার তাওফিক দান করুন। (সমাপ্ত)