অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম :
বাংলা সন বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সন। এই সনের উৎপত্তি ঘটেছে ইসলামী উৎস থেকে। বাংলাদেশে বর্ষপঞ্জি ও দিনপঞ্জির ক্ষেত্রে সন, সাল, তারিখ শব্দ তিনটি নিত্য ব্যবহৃত হয়। বর্ষ গণনায় এই তিনটি শব্দের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে রয়েছে।
বাংলাদেশে তিনটি সনের হিসেবে বর্ষ গণনা করা হয়। আর সেগুলো হচ্ছে- হিজরী সন, বাংলা সন এবং খ্রিস্টীয় সন। যে কারণে এখানকার মানুষ প্রতিবছর তিন রকমের নববর্ষের সান্নিধ্যে আসে। বাংলা নববর্ষ আসে বসন্তকালকে বিদায় জানিয়ে কালবৈশাখীর সম্ভাবনাকে বুকে ধরে গ্রীষ্মকালের সূচনাতে। ১ বৈশাখ পালিত হয় নববর্ষ। খ্রিস্টীয় বা ইংরেজী নববর্ষ আসে প্রচন্ড শীতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ১ জানুয়ারিতে। হিজরী নববর্ষ আসে ১ মহররমে ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে। এই দেশে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে পঞ্জিকার ব্যবহার সর্বজনীন রূপ লাভ করতে পারেনি। অবশ্য চান্দ্র কলার নিরীক্ষণ এবং সে অনুযায়ী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, তিথি, একাদশী ইত্যাদি নিরূপণ করার প্রথা, প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত খ্রিস্টীয় ও বাংলা সন দুটি সৌরবর্ষ এবং হিজরী সনটি চান্দ্র বর্ষ। সূর্যের পরিক্রমার হিসেবে যে সন গণনা করা হয় সেই সনকে সৌর সন বা সৌর বর্ষ এবং চাঁদের পরিক্রমার হিসেবে যে সন গণনা করা হয় তাকে বলা হয় চান্দ্র বর্ষ বা চান্দ্র সন। এই সন শব্দটি আরবি থেকে এসেছে এবং এখানে প্রচলিত সাল শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ থেকে। আমরা যে তারিখ শব্দটি ব্যবহার করি এটাও আরবি।
বাংলাদেশের প্রচলিত তিনটি সনের মধ্যে হিজরী সনই হচ্ছে সর্বপ্রাচীন সন। এখানে ইসলাম প্রচার প্রথম ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর চল্লিশ দশকের দিকে। তখন থেকেই এখানে হিজরী সনের আগমন ঘটেছে। আর স¤্রাট আকবরের আমলে হিজরী সনকে সৌর গণনায় এনে যে সন এখানে প্রচলিত হয়েছে সেটা বাংলা সন। আর খ্রিস্টীয় সন এখানে এসেছে ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পর।
কোরআন মজিদে বর্ষ গণনার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দুটি নিদর্শন। রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে আলোকপ্রদ করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের রব-এর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ ও সংখ্যা হিসাব স্থির করতে পার। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত-১২)।
ইসলাম সৌর ও চান্দ্র উভয় প্রকারের বর্ষ গণনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। কোরআন মজিদে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ এনে ইরশাদ হয়েছে : সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে। (সূরা আর রহমান : আয়াত ৫), তিনি (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে, যা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিবসকে। (সূরা ইবরাহীম : আয়াত ৩৩)।
মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়ের হিসাব ধরে রাখার মননও সঞ্চারিত হয় এবং তার থেকেই সূর্য পরিক্রমার হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে তেমনি চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবেরও উদ্ভব ঘটে। এমনিভাবে সূর্য পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন আর চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটে তা চান্দ্র সন। সূর্যের নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। একে বলা হয় সৌর বছরের দৈর্ঘ্য। অন্যদিকে চন্দ্রকলার হ্রাস ও বৃদ্ধি সম্পাদনে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা, যে কারণে এক চান্দ্র বছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট।
বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সন উৎপত্তিগতভাবে ইসলামের উত্তরাধিকার বহন করছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ১ মহররম থেকে হিসাব করে হিজরতের ১৭ বর্ষ অর্থাৎ ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর রাদিআল্লাহুতায়ালা আনহু হিজরী সনের প্রবর্তন করেন। এই সন প্রবর্তনের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলে হিজরী সনের প্রচলনও এখানে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়। ৫৯৮ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। এই সময় থেকে এখানে হিজরী সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে এবং তা জাতীয় সনে পরিণত হয়, যা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশী যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরীতে মুঘল বাদশাহ আকবর পিতা বাদশাহ হুমায়ূনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বহু সংস্কারমূলক কাজ করেন। হিজরী সন চান্দ্র হওয়ায় ঋতুর সাথে এর মাসগুলো স্থির থাকতে পারে না, ফলে রাজস্ব আদায়ে কয়েক বছর পর পর দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হওয়া দেখে বাদশাহ আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে একটি নতুন সৌর সন উদ্ভাবনের জন্য তদানীন্তনকালের একজন বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহুল্লাহ সিরাজীকে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে দায়িত্ব দেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরী সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন, তা ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবরের দরবারে পেশ করেন। আকবর তাতে অনুমোদন দান করেন এবং এক ফরমান জারি করে এই সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ঘোষণা দেন।