মুহাম্মদ মাহবুবুল হক
মানুষের মৃত্যু অবধারিত। পৃথিবীতে কেউ চিরদিন থাকতে পারে না। মৃত্যু আল্লাহর অমোঘ বিধান। জীবনের খেলাঘর থেকে অনন্তকালের পথে পাড়ি দিতেই হয়। শামিল হতে হয় মৃত্যুর মিছিলে।
কিছু মানুষের মৃত্যু হৃদয়ে কান্নার ঢেউ তুলে যায়, অন্ধকার করে যায় চারপাশকে। তাঁদের শূণ্যতা ও বিয়োগব্যথা পীড়া দেয় সবাইকে। তবে তাঁরা মরেও অমর থাকেন বিশাল কর্মময় জীবনের মাধ্যমে। ইতিহাস তাঁদের ভুলে না। কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় তাঁরা বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে। এমনি একজন মনীষী মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া। বাংলার ইসলামী জ্ঞানের আকাশ থেকে খসে পড়া একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিভে যাওয়া একটি জ্ঞানের প্রদীপ। ১৩ মার্চ সোমবার বিকেল ৪.৫০টায় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। সিলেটসহ সারা দেশের আলেম সমাজকে শোকসাগরে ভাসিয়ে নিরবে চলে যান আপন নীড়ে। এমনকি প্রকৃত ইলমে দ্বীনের ধারক এ ব্যক্তিত্ব হারিয়ে এ উপমহাদেশের আলেমরা শোকাহত। বুধবার জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহয় ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে মাওলানা আরশাদ মাদানী, পাকিস্তানের দারুল উলূম করাচি থেকে জগতবিখ্যাত আলেম আল্লামা তাকি উসমানি, আল্লামা রাফি উসমানিসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আলেমরা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাযার নামাযে লাখো মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা ও দোয়া দিয়ে বিদায় জানান। পরে বরেণ্য এ ফেকাহবিদকে দরগাহ হযরত শাহজালাল (রহ.) কবরস্থানে দাফন করা হয়। দেশের খ্যাতিমান অন্যতম শীর্ষ আলেম মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া (রহ.) একাধারে তুলনারহিত আদর্শ শিক্ষক, ইলমে ওহীর সাগর, ইলমের সকল শাখায় গভীর জ্ঞানের অধিকারী অনুপম ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় শিক্ষক। মানুষ গড়ার শ্রেষ্ঠ কারিগর। হাজার হাজার ছাত্র তাঁর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়। ইলমে হাদিস, ইলমে তাফসির, ইলমে ফিকহ, ইলমে বালাগাত ও ইলমে নাহু-সরফে ছিলো তাঁর সুভীর বুৎপত্তি ও পান্ডিত্য। ক্লাসে ছাত্রদের পড়াতেন ঝরঝরে শুদ্ধ বাংলায়। বিষয়বস্তুর সাবলীল উপস্থাপনা ও বড় বড় কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচ্যবিষয়কে প্রমাণ করতেন চমৎকারভাবে। প্রাঞ্জল ভাষার মাধুর্য বর্ণনার আলোচনা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করে নিতেন ছাত্ররা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া রহ. ছিলেন মাসআলা জানার উন্মুক্ত কল সেন্টার। বিদগ্ধ ও প্রাজ্ঞ আলেম হিসেবে এ দেশের উলামায়ে কেরামের কাছে এক নামেই পরিচিতি ছিলেন। ইসলামি ফিকহে (আইন শাস্ত্র) তুলনাহীন ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তবে ফিকহে ইসলামিতে ছিলো অনন্য পান্ডিত্য। ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণের ব্যাপারটা তো আলাদা। সাধারণ মানুষও কোনো মাসআলা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই সমাধান পেয়ে যেতো। তাঁর মেধার প্রখরতা ও স্মরণশক্তি এতোই বেশি ছিলো যে, মানুষ দৈনন্দিন সমস্যার ইসলামী সমাধান মুহুর্তেই তাঁর কাছ থেকে জানতে পারতো। যেন তিনি ছিলেন ইসলামি বিধান বলে দেয়ার একটি উন্মুক্ত কল সেন্টার। যেখান থেকে সহজে ইসলামি জিজ্ঞাসার সমাধান পাওয়া যেতো। মাদ্রাসার দারুল ইফতা তো আছেই। ক্লাসে লেকচার দেয়ার অবস্থায়ও দেখতাম হুজুরের মোবাইলে কল আসছে। লোকজন মাসআলা জানতে চাইছেন। তিনি তাৎক্ষণিক রেফারেন্সনহ সমাধান দিতেন। মাসআলা জানার জন্য প্রতিদিন পরিচিত-অপরিচিত অনেক জায়গা থেকে অনেক ফোনকল আসতো। তিনি কলদাতার পরিচয় জানার চেষ্টাও করতেন না। এই দক্ষতা ও যোগ্যতার্জন রীতিমতো বিস্ময়কর। সহজ-কঠিন, আধুনিক-নিত্য উদ্ভূত বিষয় হোক আর উসুলি বা ফুরুয়ি মাসআলা হোক- সঠিক সমাধানের ঠিকানা ছিলেন মুফতী আবুল কালাম জাকারিয়া রহ.। এজন্য বৃহত্তর সিলেটসহ সারা দেশে তাঁর তাফাক্কুহের পরিচিতিটা ছিলো ব্যাপক। শরয়ী বিষয়ে সমাধানের ইতমেনান ও বিশ্বস্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। কিতাব দেখার প্রয়োজন অনুভব না করেই স্মরণ থেকেই বলে দেয়াটা মুগ্ধ করতো মানুষকে। তখনই তিনি মানুষের শ্রদ্ধা-ভালাবাসা ও প্রশংসায় ভাসতেন। তাঁর মেধা ও বিচক্ষণতা কাছে টানতো। তাঁর এ যোগ্যতা সৃষ্টির পেছনে অবদান ছিলো প্রচুর ফেকহি কিতাব পড়াশোনা ও গবেষণায় ডুবে থাকা।
ইসলামি শিক্ষাবিদ ও গবেষক এ আলেমে দ্বীন দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-নসীহত করতেন। গতানুগতিক ধারার বাহিরে তাত্ত্বিক ও দালিলিক আলোচনা সর্বমহলের শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতো। দ্বীন প্রচারে তিনি ছুটে বেড়াতেন দেশের আনাচে-কানাচে। ইসলামের নামে ভ্রান্ত মতবাদের খন্ডন করে সত্য ও সঠিক বিষয়কে দালিলিকভাবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো তাঁর বয়ানের বৈশিষ্ট্য। তাঁর ইলমি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। ছাত্রদের কাছে তো তিনি ছিলেন জীবন্ত-চলন্ত লাইব্রেরি। আলেম-উলামারাও ইলমি বিষয়ে তাঁর মতামতকে প্রধান্য দিতেন। সর্বমহলে তাঁর গবেষণাকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচনা হতো। জ্ঞানের বিশালতায় তিনি সবার কাছে সমাদৃত ছিলেন।
ইসলামের নামে ভ্রান্ত মতবাদ বিরোধী মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনে তাঁর ডাকে সিলেটের সকলমেরুর আলেম-উলামা ও সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করতেন। বিশেষ করে সিলেট কোর্ট পয়েন্টে দু’বছর পূর্বে বেদআত বিরোধী আন্দোলন ও গতবছর আহলে হাদীস বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আহলে হক উলামায়ে কেরামের মুখপাত্র হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন। তিনি একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। যথাক্রমে উলামা পরিষদ বাংলাদেশ, খাদিমুল কুরআন পরিষদ ও মজলিসে দাওয়াতুল হক সিলেটের সভাপতি ছিলেন। তাঁর আচার-ব্যবহার ছিলো অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ। সহাস্য বদনে সবাইকে আপন করে নিতেন। উত্তম চরিত্র ও মুচকি হাসির দ্বীপ্তিতে সবার মনে জায়গা করে নিতেন।
এই মহীরূহ ১৯৫৬ সালের ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ভাগুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম লাল মিয়া। মাতার নাম খায়রুন্নেছা। জন্মস্থান বগুয়ায় প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে সুনামগঞ্জের জামেয়া ইসলামিয়া আরবিয়া রামনগর মাদরাসায় উচ্চ মাধ্যমিক ১মবর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে সিলেটের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে ভর্তি হন। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক ২য়বর্ষ থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। ছাত্রজীবনে প্রখর মেধাবী ছিলেন। সিলেটে কওমি মাদরাসাসমূহের শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত দাওরায়ে হাদীসের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক মার্কসহ শীর্ষস্থান অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই জামেয়া দরগাহর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী (রহ.) (ইমাম সাব) এর নজড় কাড়েন। তিনি তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর ১১ শাওয়াল ১৩৯৮ হিজরী সনে দরগাহ মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। এখান থেকেই কর্মজীবন শুরু করে এক যুগেরও অধিক সময় জামেয়া দরগাহয় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ, তাফসিরে বায়যাবি শরিফসহ দরসে নেযামির গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের পাঠ দেন। মৃত্যুঅবধি তিনি জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহর মাদ্রাসার মুহতামিম ও শায়খে ছানী ছিলেন। মৃত্যুর দিনও তিনি আড়াইঘন্টা বুখারি শরীফের পাঠদান করেন।
লেখালেখিতে ও তিনি ছিলেন একজন ক্ষুরধার লেখক। বিশ্লেষণধর্মী ও গবেষণামূলক রচনাই ছিলো বেশি। আরবী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিলো। প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের মধ্যে অন্যতম (১) বুখারি শরিফের বাংলা অনুবাদ, (২৮ নং পারা); ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত (২) হায়াতে ঈসা আ. (৩) সত্যের আলোর মুখোশ উন্মোচন (৪) আদাবুল মুতাআল্লিমিন (৫) প্রচলিত সাধারণ মোজার উপর মাসেহ বৈধ নয় কেন? (৬) তাক্বরীরে ক্বাসিমী শরহে তাফসিরে বায়যাবি। এ ছাড়াও অনেক অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে। জামেয়া দরগাহর মুখপত্র মাসিক আল ক্বাসিম তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশ হতো। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারার পাঠ্যভুক্ত অনেক বই রয়েছে তাঁরই রচিত ও সম্পাদিত।
আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তিনি শায়খ আবরারুল হক (রহ.) এর খলিফা কাপাসিয়ার অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান ও যাত্রাবাড়ীর মাওলানা মাহমুদুল হাসানের খলিফা ছিলেন। এছাড়া খলিফায়ে মাদানী মাওলানা আব্দুল মুমিন শায়খে ইমামবাড়ির সাথেও আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক ছিলো।
তিনি খলিফায়ে মাদানী প্রখ্যাত বুজুর্গ শায়খ আব্দুল হক শায়খে গাজীনগরী (রহ.) এর মেয়েকে বিবাহ করেন। বৈবাহিকজীবনে ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর। মৃত্যুর সময় ‘আল্লাহ আকবার’ ও ‘কালেমা’ পড়ে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি অসংখ্য ছাত্র, আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত ও অনুরাগী রেখে গেছেন। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দিন। আমীন।