ইসলামী পরিবার : জীবন ও সংসারের শান্তির নীড়

159

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের করণীয় আদব : উভয়েই ইল্ম, শরীয়তের আমল পালন করতে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করুন। দ্বীনী দায়িত্ব পালনে একে অপরকে সাহায্য করুন। একে অপরের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজন বা অন্যান্যদের কাছে অপরের দোষ-ত্র“টি আলোচনা না করে ভালো দিকগুলো আলোচনা করুন।
নিজেদের মধ্যে কখনো ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেলে তা দূর করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ক্রোধের মাথায় সমাধান না করে পরবর্তীতে স্বাভাবিক পরিবেশে সমাধানের অপেক্ষা করুন। একে অপরকে মাফ করে দিন। ধৈর্য ও সবরের প্রতিযোগিতা করুন। সন্তান-সন্ততির সামনে একে অপরের সমালোচনা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলুন। এতে উভয়েই সন্তানদের কাছে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচা যাবে এবং সন্তানদেরকে আদব শিখানোর যোগ্যতা হারাতে হবেজ না। নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক করুন। স্বামীর উচিত সংসারের এমনকি নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে কাজ করা। স্ত্রীরও উচিত স্বামীর অনুমতি নিয়েই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা। একে অপরের পিতামাত ও আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান ও যতেœর ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করা।
সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য : আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে অছিয়ত করছেন, তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে’’-(নিসা : ১১)। রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে-ইমাম (নেতা/শাসক) তার অধীনস্থ জনগণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের কর্তা, তার কর্তৃত্বের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। মহিলা হচ্ছেন তার স^ামীর গৃহের কর্তৃত্বকারিণী। তাকেও তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে–’’-(বুখারী)।
কাজেই সন্তান-সন্ততি মা-বাবার প্রতি আল্লাহর এক বিরাট আমানত। এ আমানত সংরক্ষণ করা পিতা-মাতার একটা জরুরী ফরয কাজ। সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতা মাতার অধিকারগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: ব্যক্তিগত অধিকার ও নৈতিক অধিকার। ব্যক্তিগত অধিকারের আওতায় আছে।
১. তাদের জন্য একজন ভালো মা নির্বাচন করা। ইতোপূর্বে স্ত্রী নির্বাচন করার প্রসঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
২. সুন্দর নাম রাখা। রাসূল (সা:) এরশাদ করেন, “কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিজ নিজ নাম ও পিতার নামে ডাকা হবে। কাজেই সুন্দর করে নাম রাখার চেষ্টা করো’’-(আবু দাউদ)। এমন অসুন্দর বা অর্থহীন নাম না রাখা উচিত যাতে করে সন্তানদের জন্য দুনিয়া বা আখেরাতে লজ্জার কারণ না হয়ে যায়।
৩. সন্তান জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ থেকে তাকে বঞ্চিত না করা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদেরকে পুরো দু’বছর দুধ পান করানো’’-(আল বাকারা : ১৩৩)। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, “শিশুর জন্য মায়ের দুধের ন্যায় আর কোন দুধ এতো বরকতপূর্ণ হতে পারেনা’’-(আবু দাউদ)।
৪. হালাল রুজি-রোজগার থেকে শিশুকে প্রতিপালন করা। রাসুলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “যে মাংস হারাম মাল থেকে প্রতিপালিত হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। জাহান্নাতই তার জন্য উপযুক্ত’’-(মুসনাদে আল-বারী)।
৫. সাধ্যানুযায়ী তার মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা। একটি উত্তম পারিবারিক পরিবেশে তার লালন-পালন করা। সম্ভব হলে প্রত্যেক সন্তানকেই বড় হয়ে আসলেই আলাদা বিছানায় শুতে দেয়া। দশ বছর হয়ে গেলেই তাদেরকে আলাদা বিছানায় দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) নির্দেশ দিয়েছেন। বিছানা আলাদা করা সম্ভব জনা হলে কমপক্ষে লেপ বা কম্বল আলাদা করে দিতে হবে অবশ্যই্ ছেলে এবং মেয়েদের রুম অবশ্যই পৃথক হওয়া দরকার।
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই পর্যায়ক্রমে সন্তানদের মনে পর্দা-পুশিদা সম্পর্কে ধারণা দেয়া। লজ্জা শরম ঈমানের অঙ্গ। তাদের লজ্জা উঠে যায় এমন কোন দৃশ্য পিতামাতা তাদের সামনে সৃষ্টি করা উচিত নয়। টেলিভিশনের অশ্লীল প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে তাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করা উচিত। এর বিষবাষ্প থেকে তাদেরকে যতো দূরে রাখা যায় ততোই মঙ্গল। সতর ঢাকার মতো ভালো পোশাকে, বিশেষ করে মেয়েদেরকে বড় হওয়ার অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত করানো উচিত। বেপর্দা, নগ্নতা, বেহায়াপনার ব্যাপারে তাদের মনে কচি বয়স থেকে ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে।
সন্তানদের সবাইকে সমান চোখে দেখা এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য না করা। সাহাবী নোমান বিন বাশীর (রা:) কে তাঁর পিতা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে নিয়ে এসে বললেন, আমার এ ছেলেটিকে আমার একটি ক্রীতদাস দান করে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তোমার সন্তানদের সবাইকে কি এমন করে দান করেছো? তিনি বললেন, জ্বি না। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ করো-(বুখারী)। কোন কোন পরিবারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করতে দেখা যায়। বিশেষ করে একাধিক কন্যা সন্তানের মোকাবিলায় যদি মাত্র একটি পুত্র সন্তান থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই।
নৈতিক অধিকারসমূহ : ১. বাল্য বয়স থেকেই সন্তানদেরকে সঠিক আদাব ও তারবিয়াত প্রদানের প্রচেষ্টা চালানো পিতামাতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “উত্তম আদাব তারবিয়াত প্রদানের চেয়ে বড় আর কিছু নেই যা মাতাপিতা সন্তানের জন্য করতে পারে’’-(তিরমিযী)। তিনি আরো বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদেরকে সম্মানিত করো। তাদেরকে সুন্দর আদাবসমূহ শিখিয়ে দাও’’-(ইবেন মাজাহ্)। সুন্দর আদাব তারবিয়াতের মাধ্যমেই তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর আশা করা যায়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও–(তাহরীম : ৬)। সন্তান-সন্ততির আদাব তারবিয়াত কেমন হওয়া উচিত হযরত লোকমান হাকীম-এর সন্তানদের প্রতি দশটি অছিয়ত তার উত্তম নমুনা হিসেবে আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য পবিত্র কুরআনে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “লোকমান তার সন্তানকে নসীহত করতে গিয়ে বললেন- হে বৎস, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সাথে সদাচারণের জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছে। দু’বছর পর তার দুধ ছাড়ানো হয়। নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে; আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো। আমারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে তোমাদেরকে। আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবেনা বটে, তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করে যাবে। আর যারা আমার প্রতি অভিমুখী তাদের পথ অনুসরণ করবে। অত:পর তোমরা আমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। তখন আমি তোমাদেরকে সবিস্তার জ্ঞাত করবো, যা তোমরা করে যাচ্ছিলে।
হে বৎস, কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে প্রস্তর গহীনে, অথবা আকাশগুলো বা ভূগর্ভের কোথাও আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গুপ্ত ভেদ সম্পর্কে অবগত ও সবকিছুর খবর রাখেন।
হে বৎস, নামাজ কায়েম করো। সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা হচ্ছে অত্যন্ত মহৎ কর্ম। আর অহংকার বলে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীর বুকে গর্ব ভরে পদাচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তোমার পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং তোমার কন্ঠস্বরকে নীচু করো। নিঃসন্দেহে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট আওয়াজ হচ্ছে গাধার স্বর-(সূরা লোকমান : ১৩)।
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোতে সন্তানের তারবিয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী জ্ঞানের যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে : ১. ঈমানী জ্ঞান অর্থাৎ সঠিক ইসলামী আক্বীদা, ২. পিতা মাতার হক ৩. নামায তথা শরীয়তের আহকামসমূহ এবং মাসায়েল, ৪. আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার, ৫. চারিত্রিক গুণাবলী ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় ইসলামী জ্ঞান প্রদানের জন্য কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, সীরাতুন্নবী, সাহাবা কাহিনী ইত্যাদি পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদানের জন্য কোন মাদরাসা বা শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিলেই পিতামাতার শিক্ষাদানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আনুষ্ঠানিক পাঠদান কর্মসূচীর বাইরেও দৈনন্দিন উঠাবসা সাহচর্যের সুযোগে সময় সুযোগ অনুযায়ী সন্তানদের হৃদয়ে ইসলামী আদর্শকে মজবুত করে গ্রোথিত করতে হবে। যেমন- চাচাতো ভাই বালক আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) কে একান্ত সান্নিধ্যে পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) উপদেশ দিয়ে বললেন, হে বালক আমি তোমাকে কয়েকটি জরুরী কথা শিখাতে চাই। আল্লাহর হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহর হেফাজত করলে তাঁকে তোমার প্রতি সদয় ও সাহায্যকারী। কিছু চাইতে হলে আল্লাহর কাছেই চাইবে। সাহায্য কামনা করলে আল্লাহর কাছেই করবে। জেনে রেখো, মানবগোষ্ঠীর সবাই যদি তোমার কোন কল্যাণ সাধনে একত্রিত হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে লিখে দেয়া ফায়সালা ছাড়া তারা তোমার কোন কল্যাণই করতে পারবে না। আর সবাই যদি একত্রিত হয় তোমার কোন ক্ষতিসাধন করতে, আল্লাহর পক্ষ থেকে লিখে দেয়ার বাইরে তারা এতটুকুও ক্ষতি করতে পারবে না তোমার। কলমগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়ে গেছে। কাগজের লিখাও শুকিয়ে গেছে।-(তিরমিযী) সময়মতো এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নসীহত বা উপদেশ ছোটদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। (অসমাপ্ত)