কাজিরবাজার ডেস্ক :
হুমায়ন আজাদ ‘বাঙলা ভাষা’ কবিতায় ‘শেকলে বাঁধা রূপসী, বাংলা ভাষা, তুমি-আমি-দুর্বিনীত দাসদাসী-/একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী/ আমাদের ঘিরে শাঁই-শাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার/তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-/হাহাকার রূপান্তরিত হয় সংগীতে-শোভায়।’ এভাবেই মাতৃভাষা বাংলাকে দেখেছেন। শিল্প সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে লেখা হয়নি। সব ক্ষেত্রে বর্বর পাকিস্তানীদের নানা রকম চক্রান্ত ছিল। তারা পূর্ব বাংলা থেকে বাংলা ভাষাকে বিলীন করে জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র বাংলার মানুষ সফল হতে দেয়নি। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর সব চক্রান্ত রুখে দিয়ে সেদিন বাঙালীরা নিজের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল।
উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাভাষা বিরোধী চক্রান্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাকে ধ্বংস করার অন্যতম উপায় হিসেবে তারা বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমানই ছিলেন এই হরফ পরিবর্তন চেষ্টার ‘দার্শনিক’ এবং মূল প্রবক্তা। নানা বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ক্রমাগতভাবে প্রচার করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং জনগণের মধ্যে অর্থপূর্ণ ঐক্য রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্যে পাকিস্তানের সকল ভাষার অক্ষর এক হওয়া উচিত। সিন্ধী, পুষতু, পাঞ্জাবী ইত্যাদির হরফ আরবীর মতো অথবা অনেংকাশে সেই রকম। কাজেই সেখানে বিশেষ কোন অসুবিধা নেই। যত অসুবিধা বাংলার ক্ষেত্রে। কারণ বাংলা ভাষার অক্ষর দেবনাগরী থেকে উদ্ভূত এবং তার সঙ্গে আরবী হরফের কোন সাদৃশ্যই নেই। কাজেই বাংলার ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা একেবারে মৌলিক। কিন্তু তা হলেও আরবী অক্ষর প্রচলন ব্যতীত বাংলাভাষীদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর যথার্থ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্ভব নয়। সেদিক দিয়ে এই পরিবর্তন অবশ্য প্রয়োজনীয়। বদরুদ্দীন উমরের সালে ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ বইয়ে মন্ত্রী ফজলুর রহমানের এমন ভূমিকা তুলে ধরেছেন।
মহান মাতৃভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীর স্বাধীকার অর্জন সূচিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নতুন রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিমে ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষদের এক বন্ধনে বেঁধে রাখার কৃত্রিম প্রচেষ্টা শুরু হয়। পাকিস্তানের মুসলমানদের ঐক্যের সূত্র হিসেবে একটি ভাষা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার সিদ্ধান্ত নিলে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। শিক্ষিত সমাজে প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়। ছাত্ররা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার হয় এবং আন্দোলনে নেমে পড়েন। প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ভাষা-আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিন পুলিশ ছাত্রজনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেদিন শহীদ হন রফিক, শফিউল, বরকত, জব্বারসহ নাম জানা অজানা আরও অনেকে। পুলিশের গুলির প্রতিবাদে বাংলার মানুষ ফেটে পড়েন। শুরু হয় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল সমাবেশ। ১৯৫২ সালের সেই দিনের স্মৃতি স্মরণীয় করে রেখেছে বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি মাতৃভাষা আন্দোলনের নানা বিষয় উপস্থাপন করেছে।
মাতৃভাষা হচ্ছে সেই ভাষা, চেষ্টা করে যা শিখতে হয় না। শিশু জন্ম নেয়ার পর থেকেই এই ভাষাতেই তার মনের ভাব প্রকাশ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা মাতৃভাষাকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিঃশেষে প্রাণ দান এবং এ আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতিসত্তার উপলব্ধি ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের তাজা রক্তে রাজপথ যখন রঞ্জিত হয় তখন এ দেশের মানুষ মাতৃভাষাকে নতুনভাবে অর্জন করে। এ অর্জন দিয়েছিল অদম্য সাহস, যুগিয়েছিল সীমাহীন প্রেরণা। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশ’ নামে পরিচিত হলো। একুশ পূর্ব-বাংলার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। একুশ থেকে সৃষ্টি হয় ২১ দফা। এই ২১ দফা একটি ঐতিহাসিক দলিল। ২১ দফার চারটি দফা ছিল ভাষা ও একুশ সংক্রান্ত। ২১ দফা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে জনমনে এতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে।
১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই একাডেমি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করে। ধীরে ধীরে একুশের চেতনায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এমন একটি গান বাংলার জনগণকে ক্রমাগত নাড়া দিয়ে গেছে। এই গানের প্রবল আবেগ বাঙালী মানসিকতায় পাকিস্তান নামের শাসক-শোষণে রাষ্ট্রকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। তাদের শৃঙ্খল ভাঙ্গতে বাঙালীর চেতনায় প্রথম চলে আসে ’৫২ ভাষা আন্দোলন। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে শহীদ মিনার গড়ে ওঠে। প্রতিটি শহীদ মিনার যেন ভাষা শহীদদের অগ্নিশিখা। মাতৃভাষাকে কেবল অসৎ অভিসন্ধির হাত থেকে রক্ষা করেই বাংলার মানুষ ক্ষান্ত হয়নি, তার জাতিসত্তার পরিচয়কে সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং শিল্পকর্ম, সঙ্গীত ও নৃত্যে সমৃদ্ধতর করে বাঙালী মননশীলতাকে গতিময় করে তোলে। মাতৃভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশে ক্রমাগত সক্রিয় এবং ঐতিহ্য সচেতন ছিল বলেই বাংলাদেশের জনগণ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের জনগণের এ সাফল্যের মহত্তম স্বীকৃতি আসে ১৯৯৯ সালে। ওই বছর কানাডায় বসবাসরত একটি বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপের আবেদনে এবং তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।
ভাষা-আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। যে চেতনা আমাদের বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশ এবং জাতির মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পথকে বিস্তৃত করেছে। ভাষা-আন্দোলনের প্রভাবে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশেও ভাষা-আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। ভাষা-আন্দোলন তার বহুমাত্রিক চরিত্র নিয়ে জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলা একাডেমি ভাষা-আন্দোলনেরই ফসল। বাংলা একাডেমি তাই জাতির মননের প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মূল দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। তাই বাংলা একাডেমি ভাষা-আন্দোলনের ওপর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জাদুঘর উদ্বোধন করেন। ভাষা-আন্দোলন জাদুঘর পৃথিবীর কোন দেশে নেই। সেদিক থেকে এই জাদুঘরটি অনন্য।
ভাষা-আন্দোলন জাদুঘরে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, স্মারকপত্র, ব্যঙ্গচিত্র, চিঠি, প্রচারপত্র, পা-ুলিপি পুস্তক ও পুস্তিকার প্রচ্ছদ এবং ভাষা শহীদদের স্মারকবস্তু দ্বারা উপস্থাপিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার প্রচ্ছদ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র জনতার বিভিন্ন মিছিলের আলোকচিত্র, অগ্রসরমান মিছিলকে বাধা প্রদানের জন্য সারিবদ্ধ পুলিশ বাহিনী, ধর্মঘট চলাকালে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত ছাত্রনেতা শওকত আলীকে শেখ মুজিবুর রহমান রিক্সায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ছবি, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে বক্তৃতারত পাকিস্তানের স্থপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী সংসদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তুতি, ভাষা শহীদদের আলোকচিত্র ও পরিচিতি, ভাষা শহীদদের বিভিন্ন স্মারকবস্তু প্রথম শহীদ মিনারের আলোকচিত্র, প্রভাতফেরির আলোকচিত্র, উল্লেখযোগ্য ভাষা সংগ্রামীদের ছবি ও বক্তব্য, ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কবিতা ও প্রথম সঙ্গীত ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়েছে।