সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চাঞ্চল্যকর স্কুলছাত্র শিশু মোস্তাফিজুর রহমান ইমন হত্যা মামলায় মসজিদের ইমামসহ ৪ ঘাতককে ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড) দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি তাদেরকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও অপর একটি ধারায় অর্থদন্ডসহ তাদেরকে আরো ৩ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের (জেলা ও দায়রা জজ) বিচারক মো: রেজাউল করিম আলোচিত এ রায় ঘোষণা করেন।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছে- সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার ব্রাহ্মণজুলিয়া গ্রামের মৃত মখলিছ আলীর পুত্র ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম সুয়াইবুর রহমান উরফে সুজন (২৯), একই থানার ২ নং নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র মো: জাহেদ (২৮), একই গ্রামের মৃত আব্দুল মুক্তাদিরের পুত্র রফিকুর রহমান (৩৪) ও মৃত আব্দুল কাবিরের পুত্র ছালেহ আহমদ (২৫)। গতকাল বুধবার রায় ঘোষণার সময় ৩ আসামী আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত থাকলেও আসামী ছালেহ আহমদ পলাতক ছিলো।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি গ্রামের সৌদি প্রবাসী মো: জহুর আলীর পুত্র ও লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণীর ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান ইমনকে ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ অপহরণ করা হয়। পরে মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পরও অপহরণকারীরা শিশু ইমনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত ইমনের পিতা জহুর আলী বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামী করে ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার নং-৩২ (২৮-০৩-২০১৫)।
৮ এপ্রিল মোবাইল ট্যাকিংয়ের মাধ্যমে নগরীর দক্ষিণ সুরমা কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে শিশু ইমনের হত্যাকারী স্থানীয় মসজিদের ইমাম সুয়াইবুর রহমান উরফে সুজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। পরে পুলিশ তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বিষের বোতল ও রক্তমাখা কাপড় উদ্ধার করে। এমনকি বাতিরকান্দি হাওর থেকে ইমনের মাথার খুলি ও হাতের হাড় উদ্ধার করে এবং জড়িতদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ৩০ জুন সুনামগঞ্জ জেলার গোয়েন্দা শাখার এসআই দেবাংশু কুমার দে আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। পরে মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের গ্রেজেট হয়ে ২০১৬ সালের ৩১ আগষ্ট মামলাটি সুনামগঞ্জ আদালত থেকে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতের স্থানান্তর করা হয় এবং ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্র“য়ারী ৭ আসামীর মধ্যে ছাতক থানার বাতিরকান্দি গ্রামের মৃত আব্দুল করিমের পুত্র আব্দুল বাহার (৫৩), একই এলাকার মৃত আব্দুল লতিফের পুত্র নুরুল আমিন (৫৬) ও ইসমাইল মিয়ার পুত্র বাচ্চু মিয়াকে (২৭) বাদ দিয়ে সুয়াইবুর রহমান উরফে সুজন, মো: জাহেদ, রফিকুর রহমান ও ছালেহ আহমদকে অভিযুক্ত করে আদালত এ মামলার কার্য্যক্রম শুরু হয়। গত সোমবার এ মামলার যুক্তিতর্ক শেষে বুধবার চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোণা করেন আদালত।
দীর্ঘ শুনানী ও ২৬ সাক্ষীর মধ্যে বর্তমানে হবিগঞ্জের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক মোহাম্মদ শহীদুল আমিন ও সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্যাম কান্ত সিনহা, ডাক্তার, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নিহতের মা বাবাসহ ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত আসামী সুয়াইবুর রহমান উরফে সুজন, মো: জাহেদ, রফিকুর রহমান ও ছালেহ আহমদকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) এর ৮/৩০ তৎসহ দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদন্ড (ফাঁসি) ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং অপর ২০১ ধারায় তাদের প্রত্যেককে ৩ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে আসামীদের। রায় ঘোষণার সময় আদালতে ইমনের পিতা-আত্মীয় স্বজন ও আসামীদের পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
মামলাটি পরিচালনা করেন রাষ্ট্রপক্ষের স্পেশাল পিপি এডভোকেট কিশোর কুমার কর, স্ট্রেট ডিফেন্স এডভোকেট ফাহ্ত্তা নাজরিন মওদুদ, আসামীপক্ষে এডভোকেট শহিদুজ্জামান চৌধুরী ও এডভোকেট হাসান প্রমুখ।
৪ আসামীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সন্তোষ প্রকাশ করে এক প্রতিক্রিয়ায় মামলার বাদি ও নিহত ইমনের পিতা মো: জহুর আলী বলেন, ছেলেকেতো আর পাব না। ৩ বছর ১০ মাস ৯দিন পর ৪ আসামীর মৃত্যুদন্ড হয়েছে। যাতে এ রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকে এবং দ্রুত আসামীদের রায় কার্যকর হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশে যেন আর কোন মা-বাবা আমার ইমনের মতো এভাবে হারাতে না হয়।
সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি এডভোকেট কিশোর কুমার কর বলেন, চাঞ্চল্যকর ইমন হত্যা মামলার আসামী মসজিদের ইমাম সুয়াইবুর রহমান উরফে সুজন, মো: জাহেদ, রফিকুর রহমান ও ছালেহ আহমদকে অর্থদন্ডসহ মৃত্যুদন্ড (সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি) দিয়েছেন আদালত। লোমহর্ষক এ ঘটনায় অভিযুক্তরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। তিনি আদালতকে ধন্যবাদ জানান এবং দ্রুত রায় কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আহবান জানান এবং এ রায়ে সন্তষ্টি প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই পিপি।