ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির শেকড়ে বাধা শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার

205

॥ আবু মারওয়ান ॥

বিকাল ৩টা। কালো বোরকা পরিহিত পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব জনৈক মহিলা অজু শেষে মাজারের পাশে স্থাপিত মহিলা এবাদত খানায় প্রবেশ করছেন। পাশে অজু করতে দাঁড়িয়ে আছেন জন পাঁচেক মহিলা, সাথে ছোট দুটি শিশু। আবার মহিলা এবাদত খানায় মহিলাদের দীর্ঘ লাইন। সেখানে কেউ নামাজরত, কেউ আবার তসবীহ পড়ছেন, কেউ আবার গভীর ধ্যানে মগ্ন। কারো দিকে কারো তাকানোর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু নিজ নিজ আরাধনায় মগ্ন গোটা ঘরের মহিলারা। স্টাইলসের মনোরম কারুকাজ খচিত দীর্ঘ প্রবেশ পথ পরেই দেখা যায় শতাধিক লোকের সমাগম। সেখানে আবার ছেলে, বুড়ো, যুবক অনেক লোক দাঁড়িয়ে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন, কেউ আবার জিয়ারতরত, আবার কেউ জিয়ারত শেষে নিজ নিজ উদ্যোগে শিরনী বিতরণ করছেন। আবার অনেকে এখানকার প্রবেশ পথে স্থাপিত চেয়ারে বসে আলাপরত। রাস্তার পাশে স্থাপিত দান বাক্সে আবার কেউ কেউ দান করছেন।
মাজারে আগত সত্তর ঊর্ধ্ব মরিয়ম বিবি বলেন, এখানে উদ্দেশ্য নিয়ে মানত দিলে তা পূরণ হয়। তাই মানত দিয়ে নফল নামাজ পড়তে আসছি। আল্লাহ যেন এই নেক বান্দার উসিলায় আমার উদ্দেশ্য সফল করেন।
পরিবহন শ্রমিক জাহেদ জানায়, বিভিন্ন দুর্ঘটনাসহ সব বালা মুসিবত থেকে রক্ষা পেতে আমি সহ বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিক এই মাজারে দান-খয়রাত করি। শুনেছি এখানে দান করলে নাকি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার ইউনিয়নের বেতসুন্ধি ফকিরোগাঁওস্থ শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজারের প্রতিদিনকার দৃশ্য এটি। বিশেষ করে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবারে এখানে পুণ্যার্থীদের সমাগম বেশি ঘটে। স্থানীয় গ্রামবাসী ও মাজার কমিটির তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন যাবৎ এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পুণ্যার্থীদের সমাগমে মাজার এলাকার প্রতিদিনই সরগরম থাকে। এ মাজারকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকায় একটি উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাম পাশর্^স্থিত এ মাজারটি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা শাহ ফারুক আহমদের দিক নির্দেশনায় স্থাপিত হওয়ার পর থেকে হাটি হাটি পা পা করে এ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় গ্রামবাসী খুব উৎফুল্ল। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে মাজার নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। মাজারের প্রতিদিনকার ভক্তবৃন্দের দানকৃত খয়রাতি টাকা ও জিনিসপত্র সংরক্ষণ শেষে প্রতি বছর বেশ ঘটা করে একটি ওয়াজ মাহফিল পালন করা হয়। প্রতি বছরকার এ ওয়াজ মাহফিলে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটে। বার্ষিক এ উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা গ্রামে উৎসবের সৃষ্টি হয়। বেতসুন্ধি ফকিরোগাও, গ্রামবাসী সহ গোটা এলাকা জনসাধারণের সক্রিয় উপস্থিতি ওয়াজ মাহফিল একটি সুন্দর ধর্মীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। দেশের নামকরা ইসলামি ব্যক্তিরা এখানে বয়ান পেশ করেন। ওয়াজ শেষে আগত মুসল্লীদের মধ্যে শিরনী বিতরণ করা হয়। এখানকার শিরনীর সুনাম দেশ ও বিদেশে সমাদৃত।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ফকিরোগাঁও গ্রামের মরহুম ফকির সুরুজ আলী অর্ধশত বছর আগে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাম পাশর্^স্থিত একটি বিশাল গাছের গোড়ায় নিজ উদ্যোগে মমবাতি জ¦ালানোর মাধ্যমে প্রতিদিন সেখানে উপাসনা করতেন। দীর্ঘদিন এসব কার্যক্রম পরিচালনা হতে দেখে গ্রামবাসী তাহার সাথে একাত্ম হয়ে মাওলানা শাহ ফারুক আহমদের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে অবস্থিত মাজারটির সংস্কার সাধন করেন এবং এটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিশাল সময়ের ব্যবধানে সামান্য অবস্থান থেকে আজকের এই অবস্থানে দাঁড়িয়েছে শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার। দর্শক আকৃষ্টকারী মনোরম কারুকাজে খচিত মাজারটি আজ গোটা এলাকার মানুষের প্রাণের শেকড়ে অবস্থান নিয়েছে। গ্রামবাসী মাজারটিকে তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করছেন।
মরহুম ফকির সুরুজ আলীর বর্তমান বংশধর মোঃ আব্দুশ শহীদ এ ব্যাপারে আলাপকালে জানান, আমার পূর্ব পুরুষের হাতেগড়া এ ধর্মীয় স্মৃতি ধরে রাখতে আমি সহ আমার পরিবার বেশ সক্রিয়। মাজার কমিটি এবং আমরা মিলেমিশে মাজারের তদারকি করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনই আমাদের প্রাণের প্রিয় ধর্মীয় আবেগ অনুভূতির স্থান শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার এর খেদমত করে যাব।
শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ মুশাহিদ আহমদ রনি এ ব্যাপারে আলাপকালে জানান, ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার এর সাথে এলাকাবাসীর ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি জড়িত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত সুচারু ভাবে মাজারের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাজারের নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি ক্রয় করে তাতে মাটি ভরাট করা হয়েছে। অতিশীঘ্রই মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। একে একে ২৮টি ইসালে সওয়াব মাহফিল সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে তিনি আসন্ন ২৯তম ইসালে সওয়াব মাহফিলে (২৪ জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার) সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
ফকিরোগাঁও জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা জালাল উদ্দিন জানান, এ মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন শত শত ভক্তের আবির্ভাব ঘটে এই স্থানে। মানত প্রদান, নফল নামাজ আদায় সহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মুসল্লীরা এখানে আসেন। প্রতিদিনকার বিশাল জনসমাগম সত্যিই এখানে এক বিরল দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
৬নং লালাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পীর ফয়জুল হক ইকবাল বলেন, শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার অত্র এলাকাবাসীর জন্য এক নিয়ামত। এ মাজারকে কেন্দ্র করে এখানকার গোটা এলাকায় এক ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন শত শত লোকের সমাগম সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মাজার কমিটি আন্তরিকতার মাধ্যমে মাজার পরিচালনা করায় এখানে দিন দিন জন সমাগম বাড়ছে। তিনি ধর্মীয় আবেগ অনুভূতির স্থান শাহ আব্দুর রহিম (র:) মাজার এর সার্বিক কল্যাণে সকলকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক ও গ্রন্থকার