॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমানতের খিয়ানত একটি জঘণ্য কাজ এবং এর দ্বারা উপার্জিত সম্পদও হারাম। আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমাদের কাউকে যদি কোন ব্যক্তি কোন কিছুর আমানতদার বানায় বা কোন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে, তাহলে সে যেন উক্ত আমানত প্রাপককে পরিশোধ করে দেয় এবং সে যেন (এ ব্যাপারে) তার রব আল্লাহকে ভয় করে। তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, যে কেউ তা গোপন করে অবশ্যই তার অন্তর পাপী। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।’’ অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তোমাদের ওপর ন্যস্ত আমানতের খেয়ানত করো না। অথচ তোমরা জান।’’ অপর এক আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন: ‘‘আর কোন নবীর জন্য কোন কিচু আত্মসাৎ করা মানানসই নয়, আর যে ব্যক্তি কোন কিছু আত্মসাৎ বা গোপন করবে, কিয়ামতের দিন সে উক্ত আত্মসাৎকৃত বস্তসহ উপস্থিত হবে; অত:পর প্রত্যেককে তার পরিপূর্ণ বদলা দেয়া হবে এবং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না।’’
মুফাসসিরগণ বলেছেন: এ আয়াত সাহাবী আবু লুবাবা সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। বনু কুরাইয়া গোত্রের পল্লীতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা বসবাস করছিল। রসূল (স.) বনু কুরাইযাকে অবরোধ করে রেখেছিলেন। তিনি আবু লুবাবাকে কোন প্রয়োজনে বনু কুরাইযার কাছে পাঠিয়েছিলেন। বনু কুরাইযার লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: ‘‘হে আবু লুবাবা! আমাদের ব্যাপারে রসূলের রায় অনুসারে আমরা যদি নেমে আসি, তা হলে আমাদের কি হবে বলে তোমার মনে হয়? আবু লুবাবা নিজের গলার দিকে ইংগিত দিয়ে বুঝালেন, তোমাদেরকে যবাই করা হবে। কাজেই নেমে এসো না। তাঁর এ কাজটি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। আবু লুবাবা নিজেও স্বীকার করেন যে, আমি কাজটি করার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম যে, আমি খিয়ানত করে ফেলেছি। এরপর আবু লুবাবা মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে নিজেকে ছয়দিন যাবত বেঁধে রাখেন এবং তাঁর তাওবা কবুল হবার ঘোষণা আসার পরই নিজেকে মুক্ত করেন।
ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন: ‘‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শাহাদাত বরণকালে আমানতের খিয়ানত ব্যতীত সকল গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। আমানতে খেয়ানতকারীকে কিয়ামতের দিন হাজির করা হবে এবং বলা হবে, তোমার আমানত ফেরত দাও। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে ফেরত দেব? দুনিয়ার তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তার কাছে যে জিনিসটি আমানত রাখা হয়েছিল, তাকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থলে হুবহু যে আকারে রাখা হয়েছিল সেই আকারে দেখানো হবে। অতপর বলা হবে, তুমি ওখানে নেমে যাও এবং ওটা বের করে নিয়ে এসো। অতপর সে নেমে যাবে এবং জিনিসটি ঘাড়ে করে নিয়ে আসবে। জিনিসটি তার কাছে দুনিয়ার সকল পাহাড়ের চেয়ে ভারী মনে হবে। সে মনে করবে যে জিনিসটি নিয়ে আসলে সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু জাহান্নামের মুখের কাছে আসা মাত্র আবার আমানতের জিনিসসহ জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে যাবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে।
আমাদের সমাজে যাদু-টোনা করে বিভিন্ন জঘণ্যতম কাজের মাধ্যমে একশ্রেণীর লোকজন উপার্জনের পথ খুলে নিয়েছে। অথচ এ যাদু-টোনা কবীরা গুনাহের মধ্যে অন্যতম একটি গুনাহ। যাদু কবীরা গুনাহ হওয়ার কারণ এই যে, এ কাজ করতে হলে কাফির না হয়ে করা সম্ভব হয় না। আল্লাহ বলেন: ‘‘শয়তানরা কুফরিতে লিপ্ত হয়ে মানুষকে যাদু শিক্ষা দিতো।’’
মূলত অভিশপ্ত শয়তান মানুষকে যাদু শিক্ষা দেয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সাথে শিরক করা। হারূত ও মারূত নামক দু’জন ফিরিশতার ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লারহ বলেন: ‘‘তারা উভয়ে কাউকে যাদু শিক্ষা দেয়ার আগে এ কথা বলে দিত যে, আমরা পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তোমরা কুফরিতে লিপ্ত হয়ো না। তারপর তাদের কাছ থেকে লোকেরা এমন যাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো যায়। অথচ তারা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তা দ্বারা কারো ক্ষতি করতে পারতো না। তারা যে যাদু শিখতো তা তাদের শুধু ক্ষতি করতো, উপকার করতো না। আর তারা এ কথাও জানত যে, যে ব্যক্তি যাদু আয়ত্ত করবে, আখিরাতে সে কোন অংশ পাবে না।’’
ইসলামী বিধান মতে যাদুকরের শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। কারণ তা আল্লাহর সাথে কুফরি অথবা কুফরির পর্যায়ভুক্ত। রসূল (স.) যে হাদীসে ‘‘সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ’’ ত্যাগ করতে বলেছেন, তাতে যাদুও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। “আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রসূল (স.) বলেছেন: ‘‘তোমরা সাতটি ভয়াবহ গুনাহ থেকে বিরত থাকো। (ক) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা (খ) যাদু করা, (গ) শরীয়তের বিধিসম্মতভাবে ছাড়া কোন অবৈধ হত্যাকান্ড ঘটানো, (ঘ) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাত করা, (ঙ) সুদ খাওয়া, (চ) যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানো এবং (ছ) সরলমতি সতীসাধ্বী মু’মিন মহিলাদের ওপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ।
পথভ্রষ্ট বহু মানুষের যাদুর আশ্রয় নিতে দেখা যায়। কারণ তারা একে শুধু একটা হারাম কাজ মনে করে। আসলে যাদুও যে কুফরী তা তারা জানে না। স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো, বেগানা পুরুষ ও স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রণয় সৃষ্টির কাজে এমন সব মন্ত্র পড়ে যাদু করা হয়, যার বেশির ভাগ শিরক ও কুফরিতে পরিপূর্ণ। কাজেই আল্লাহকে ভয় করা উচিত এবং দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গায় ক্ষতিকর এমন কাজের ধারে কাছে যাওয়া উচিত নয়। হাদীসে এসেছে: ‘যাদুকরের শাস্তি হত্যা করা’’
পরিশ্রম না করে পরনির্ভরশীল হয়ে জীবন পরিচালনা করা ইসলামসম্মত নয়। বরং তা ঘৃণিশত কাজ। আল্লাহ প্রতিটি মানুষের জন্য তার রিযিকের যথাযথ ব্যবস্থা করে রেখেছেন। মানুষ পরিশ্রমের মাধ্যমে হালাল উপায়ে উপার্জন করে নিজে খাবে এবং পরিবার-পরিজনকে খাওয়াবে। মানুষ স্বীয় কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উপার্জন না করে বসে বসে খাবে তা ইসলাম সমর্থন করে না। এ জন্যই ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ভিক্ষা করার অর্থ হলো তার মধ্যে অন্তর্নিহিত আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা ও উপার্জন-প্রতিভাকে কাজে না লাগানোর ফল। তাই-ই নয় শুধু, সে মনুষ্যত্বের চরম অপমানও করে।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রসূল (স.) বলেছেন: ‘‘তোমাদের কেউ তার পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রি করা, কারো নিকট ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম চাই সে দিক বা না দিক।’’
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রসূল (স.) বলেছেন : ‘‘লোকদের কাছে ভিক্ষা করলে অবশেষে কিয়ামতের দিন এমনভাবে উপস্থিত হবে যে তখন তার মুখমন্ডলে এক টুকরাও গোশত থাকবে না।’’
সাহল ইবনে হানযালিয়া বলেন, রসূল (স.) বলেছেন : ‘‘যে ব্যক্তি ভিক্ষা চায় অথচ তা বেঁচে থাকার সম্বল তার আছে, নিশ্চয় সে অধিক আগুন সংগ্রহ করছে।’’
ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর মতে : ‘‘যার কাছে দুবেলার খাবার আছে, তার জন্য সাওয়াল করা জায়েয নয়।’’
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, ঢাকা শহরে ১৪৯৯৯ জন ভাসমান লোক রয়েছে। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ১১৭১৭ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৩২৮৩ জন। ভাসমান লোক তারা-যারা খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, মাজারে, বাস টারমিনালে, রেলওয়ে স্টেশনে, প্যসেঞ্জার সেডে, স্টেডিয়ামের বারান্দায়, সরকারী ও বেসরকারী অফিসে, ফুটপাত ও পার্কে রাত্রীযাপন করে।
রাষ্ট্রীয় আইনে ভিক্ষাবৃত্তিতে কাউকে উৎসাহিত বা নিয়োজিত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের দন্ডবিধির ভাষ্যানুযায়ী: ‘‘যিনি কোনো ব্যক্তিকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করেন বা তৎকর্তৃক ভিক্ষা করান অথবা যিনি কোনো শিশুর হেফাজত, দায়িত্ব বা তত্ত্বাবধানে থাকাকালে উক্ত শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করতে বা তৎকর্তৃক ভিক্ষা করাতে অপসহায়তা বা উৎসাহ দান করেন তিনি তজ্জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের সশ্রম কারাদন্ড অথবা অর্থদন্ড কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।’’
মডেলিং একটি পেশা। এটি যদি ইসলাম পরিপন্থী না হয় তাহলে তা জায়েয, অন্যথায় তা হারাম। কেননা বর্তমান মডেলিংয়ের মধ্যে যে সকল বেপর্দা ও অর্ধ-উলঙ্গ এবং বেহায়াপনা চিত্র দেখা যায় কোন ক্রমেই তা ইসলামে সমর্থিত নয়। আর এ উপার্জিত সম্পদও হালাল হতে পারে না। বিজ্ঞাপন সংস্কৃতির সহযোগী অনুষঙ্গ হিসেবে মডেলিং ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। আধুনিক অর্থনীতি বলে বিজ্ঞাপন ব্যতীত কোনো পণ্যের বাজারজাতকরণ সম্ভব নয়। আর বিজ্ঞাপনের সাথে মডেলিংয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তারকা খ্যাতিকে পণ্যের সঙ্গে সংয্কুত করে পণ্যকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং তা চাহিদা সৃষ্টির কৌশল সর্বজনবিদিত। তেমনি পণ্যের বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে অনেক ব্যক্তি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হতে পারে। মডেলিং একটি স্বতন্ত্র পেশায় পরিণত হয়েছে। পণ্যের বাজার সম্প্রচারিত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে মডেলিংয়েরও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। প্রায় সারা বিশ্বে মডেলিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমাদের দেশেও সে রকমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। বিদেশে ৬০% অর্থ বিজ্ঞাপন খাতে ব্যয় হয়। সেখানে মডেলদের পারিশ্রমিক উচ্চমূল্যের। ইসলাম অপ্রয়োজনীয়ভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সমর্থন করে না, কারণ মডেলিংয়ের দ্বারা পণ্যের গুণগতমান বাড়ে না।
বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচার ও অবৈধ পন্থায় উপার্জনের ছড়াছড়ি। এর মধ্য থেকে আমাদের সঠিক ও বৈধ পন্থায় উপার্জন করে তা জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, সৎভাবে যে কোনো কাজই হোক না কেন তা পবিত্র, যতই তা নগণ্য হোক না কেন। হালাল উপার্জন আল্লাহর পছন্দনীয়, বেকার লোককে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া ঈমানী দায়িত্ব, কাজের বিনিময়ে মজুরি প্রদান ও গ্রহণ সম্পূর্ণ বৈধ। বেতন সম্মানজনক হতে হবে যাতে পরিবারসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ হতে পারে, চাকরির পূর্বেই বেতন মজুরি নির্ধারণ করে নিতে হবে, মালিকের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে কোন চুক্তি ও শর্ত শ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ অন্যায়। কাজের সময় ও মেয়াদ নির্ধারিত থাকতে হবে, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক হবে আত্মীয়তার মত, অসহায় মানুষকে সাহায্য করা ঈমানদার লোকদের দায়িত্ব। মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে বৈষম্যের অবসান, চাকরির শর্ত ও চুক্তি নির্ধারণ হবে উভয়ের সম্মতিতে এবং কেউই চুক্তি লঙ্ঘন করবে না, উত্তম শ্রমিকের পরিচয় হলো, শক্তিশালী ও বিশ্বস্ততা আর উত্তম মালিকের পরিচয় হলো, জালিম হবে না, সৎকর্মপরায়ণ হবে, সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ দিবে না, শ্রমিকের চুক্তি করার ও কথা বলার স্বাধীনতা আছে, ঈমানদারগণ সকল কাজ আল্লাহর বিধান মোতাবেক সম্পন্ন করবে। (সমাপ্ত)