ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর
সুপারিশ শব্দটি আরবিতে বলা হয় শাফায়াত যার অর্থঃ কাছে টানা, মিলিয়ে নেয়া, নিজের সাথে একত্রিত করে নেয়া ইত্যাদি শরীয়তের পরিভাষায় কল্যাণ লাভ অথবা অকল্যাণ প্রতিহত করার আশায় অপরের জন্য মধ্যস্ততা করাকে সুপারিশ বা শাফায়াত বলে।
দুনিয়াতে আমরা দেখি কারো চাকুরীর জন্য, কারো কোন সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য কিংবা বিচারকের বিচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য কোন না কোন ভাবে মানুষ একে অপরের জন্য আবেদন বা সুপারিশ করে থাকে।
দুনিয়াতে সাধারণত দুটি কারনে মানুষ সুপারিশ করে থাকে।
এক. সুপারিশ কারী হয় ভুক্তভোগীর কাজ থেকে কোন সুবিধা ভোগ কোরে সুপারিশ করে।
দুই. নচেৎ তার শুভাকাঙ্খি হিসেবে একান্ত কল্যানের জন্য সুপারিশ করে থাকে। কিন্তু আখেরাতে হাশরের ময়দানে চূড়ান্ত বিচারের দিনে কেউ কি কারো জন্য সুপারিশ বা শাফায়াত করতে পারবে.? এটা নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে নানান মত ও পথ। কেউ মনে করেন আমরা তেমন কোন আমল না করলেও কোন পীর, বুযুর্গ কিংবা কোন ওলী-আওলীয়ার সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুললে তারা তাদের ভক্তকূলদের জন্য হাশরের ময়দানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আল্লাহর দরবারে বসে যাবেন এবং তাদের ভূলত্রুটি মার্জনা করিয়ে তাদের জন্য জান্নাতের সুপারিশ করিয়েই তবে সেখান থেকে উঠবেন। কিন্তু এদের এ অবাস্তব কল্পনা একবারেই অমূলক ও ভ্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়।
তাদের এ অমূলক চিন্তার কঠোর প্রদিবাদ করে আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিলেন সূরা বাকারার ২৫৪ নং আয়াতে এভাবে বলছেন- অর্থাৎ: সেদিন কোন কেনাবেচা চলবে না, কারো বন্ধুত্ব কাজে লাগবে না এবং কারো কোন সুপারিশও চলবে না ৷
আবার আর একশ্রেণীর অজ্ঞ মানুষেরা মনে করে বিশ্ব জাহানের রবের সরাসরি ডাকা যায় না, তাকে ডাকতে হলে কোন মাধ্যম লাগে। যার মাধ্যমে আল্লাাহর সান্নিধ্য পাওয়া যাবে। তাই তারা বিভিন্ন জড় পদার্থের কিংবা কোন মানুষ বা প্রাণীকে প্রভূ বানিয়ে উপাসনা করা শুরু করে। আর ভাবতে থাকে তারা হাশেরের ময়দানে তাদের জন্য তাদের উপাস্যগুলি আল্লাহর কাছ থেকে দেন-দরবারের মাধ্যমে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করিয়ে ছাড়বে।
এদের যুক্তি ও চিন্তাটা হলো আরো ভ্রান্ত ও কুফরী। আল্লাহর লা’নত থেকে এদের মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আল্লাহ এদের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করছে এভাবে যে-
তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে উপাসনা করছো তারাতো নিছক একটি মূর্তি ছাড়া আর কিছুই না, আর তোমরাতো একটি মিথ্যা (উপাস্য) তৈরি করছো৷ আসলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তোমরা উপাসনা করো তারা তোমাদের কোন রিযিক দেবার ক্ষমতা রাখে না, কাজেই তোমরা আল্লাহর কাছে রিযিক চাও, তাঁরই বন্দেগী করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তারই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে৷ [সূরা আনকাবুত-১৭)
আর আল্লাহকে ডাকার জন্য কোন মাধ্যম লাগে না বরং তিনি বান্দার সকল আহবান সরাসরি শুনেন ও জানেন তিনি বলেন-
আর হে নবী! আমার বান্দা যদি আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দিন, আমি তাদের কাছেই আছি৷ যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত। একথা আপনি তাদের শুনিয়ে দিন, হয়তো তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে৷ [সূরা বাক্বরা ১৮৬]
কাজেই যারা নিজেরাই অথর্ব, অক্ষম তারা কিভাবে হাশরের মায়দানে আল¬াহর কাছ থেকে সুপারিশ করে তাদের মুক্তি দিতে পারে? গোটা কুরআনের মধ্যে মোট চার জায়গায় সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। সেখান থেকে যানা যায় হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তি বস্তুর জন্য সুপারিশ করতে পারবে না। আর এ জাতীয় সুপারিশ করার কোন সুযোগও আল্লাহর কাছে থাকবে না। কাজেই এ ধরনের চিন্তা খুবই অমূলক যে, অমূক পীর, বাবা, বুযুর্গ, ওলী বা কোন জড় বস্তুর প্রভুরা সুপারিশ করে কঠিন হাশরের ময়দানে আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। এ ধরনের কোন কেনা-বেচা, সুপারিশ কিংবা কোন দেন-দরবার আল্লাহর কাছে চলবে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা’য়ালা সে দিন কারো জন্য করুনা করে সুপারিশ করার অনুমতি দিলে তিনিই কেবল কোন তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে সুপারিশ করতে পারবেন। অন্যথায় তার অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি তার মর্জিমত কোন মুরিদ বা ভক্তকূলকে সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখবে না।
যেমন সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- অর্থাৎ কে আছে তার (আল্লাহর) অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে ?
সেদিন কোন ব্যক্তি কেন, আল্লাহর কোন নিকটতম ফেরেস্তা কিংবা কোন নবীও তার অনুমতি ছাড়া কারো জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখবে না। যেমন কুরআনের সূরা নাজমের ২৬ নং আয়াতে বলা বলা হয়েছে-
২৬) আসমানে তো কত ফেরেশতা আছে যাদের সুপারিশও সেদিন কোন কাজে আসবে না যতক্ষণ না আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশী তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দান করেন৷
মুসলিম শরিফের হাদিসে আসছে- নবী করীম সাল্লাহু আলাহি ওসাল্লাম বলেছেন- হাসরের দিনে আমি আল্লাহ তা’য়ালার আরশের নিচে গিয়ে সেজদায় পড়ে যাব। আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন আমি ততক্ষণ এ ভাবেই থাকবো। অতৎপর আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে বলবেন, তুমি বলো, তোমার কথা শুনা হবে, সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গৃহিত হবে। তিনি বলেন: সেদিন (সুপারিশের জন্য) আমাকে সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে আমি (সুপারিশ করে) জান্নাতে নিয়ে যাব। (মুসলিম-১/১৮০)
সেদিন শুধুমাত্র তিনিই সুপারিশ করতে পারবেন যাকে আল্লাহ এ সুপারিশের অনুমতি প্রদান করবেন যেমন সূরা আম্বিয়ার ২১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
যাদের পক্ষে সুপারিশ শুনতে আল্লাহ সম্মত হবেন তাদের ছাড়া আর কারো সুপারিশ গৃহিত হবে না।
কাজেই যেখানে ফেরেশতা, নবী অথবা কোন সৎলোক প্রত্যেকের সুপারিশ করার এখতিয়ার অবশ্যই আল্ল¬াহর অনুমতি সাপেক্ষ৷ আল্লাহ তাদের কাউকে কোন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করার অনুমতি দিলে তবেই তিনি তার পক্ষে সুপারিশ করতে পারবেন৷ তারা নিজেই আগ্রহী হয়ে কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না৷ আবার সুপারিশ করলেও তার সুপারিশ শোনা বা না শোনা এবং তা কবুল করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল সেখানে এ ধরনের ক্ষমতাহীন কোন ব্যক্তি বা জড় পাদার্থের সামনে মাথা নোয়ানো, সুপারিশ পাবার জন্য তাদের কাছে ধর্ণা দেওয়া কিংবা তাদের খুশি করার জন্য বিভিন্ন নাজরানা পেশ করা অথবা প্রার্থনার জন্য তাদের কাছে হাত পাতা কিভাবে সমীচীন ও উপযোগী হতে পারে ? এ ধরনের চিন্তা করা অজ্ঞ ও বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন