মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে অস্থিরতা ॥ নেতাকর্মীরা হতাশ ॥ দল ছাড়ছেন অনেকেই

96

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে চলছে অস্থিরতা। একদিকে দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ। অন্যদিকে মনোনয়ন না পেয়ে অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। দল থেকে পদত্যাগ করছেন কেউ কেউ। পাশাপাশি নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের এরশাদের অসুস্থতা ও দলের কে হাল ধরবেন এ নিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ।
যেখানে নির্বাচনের মাত্র ২৯ দিন বাকি, সেখানে সারাবছর গুছিয়ে ওঠা দলটিতে হঠাৎ করেই নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আসন বণ্টন, মনোনয়নের চিঠি বিতরণ নিয়ে ভেতরে-বাইরে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে। এরশাদের অসুস্থতার কারণে ভেঙ্গে পড়েছে দলটির চেন অব কমান্ড। কেউ কাউকে মানতে চাইছেন না। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে নেতাকর্মীরা কথা বললে কেউ কোন দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। সর্বশেষ দলের মনোনয়ন বঞ্চিতদের ক্ষোভের মুখে বৃহস্পতিবার জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। যদিও মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়ে এখন এরশাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য আসেনি। দলের মহাসচিব মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করে বলেছেন, একটি পক্ষ দলের সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নেই। তাছাড়া জাপা একটি বড় দল। মনোনয়ন নিয়ে অনেকের মধ্যে কষ্ট থাকা স্বাভাবিক। তার মানে এক্ষেত্রে বাণিজ্যের কিছু নেই। যদিও দলের শীর্ষ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাপার পক্ষ থেকে তিনটি মনোনয়নের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর একটি করেছেন দলের চেয়ারম্যান এরশাদ, অপরটি রওশন এরশাদ ও তৃতীয়টি রুহুল আমিন হাওলাদার। যে যার মতো করে নিজের সমর্থক বা পছন্দের ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অভিযোগ আছে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়েও মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। দলে ক্ষোভ, বিদ্রোহ বেড়েছে। এত ক্ষোভ বিদ্রোহ এর আগের নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে খুব একটা দেখা যায়নি।
গত কয়েকদিন মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা দেখা গেছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে। দলীয় মনোনয়ন ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। দলীয় প্রার্থীদের নাম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হওয়ায় সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। নিজেদের প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য সংবাদ সম্মেলন ডেকেও তা প্রকাশ করতে পারেনি দলটি।
এ নিয়ে পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকেও অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। তবে তিনি জানান, কৌশলগত কারণে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করতে পারছে না জাপা। নেতাকর্মীদের দাবি, ৩০০ আসনেই জাপার প্রার্থী দিতে হবে। এ অবস্থায় পার্টির মহাসচিব জানান, প্রাথমিকভাবে ২২০ আসনে মনোনয়ন দাখিল করবে জাপা। পরে মহাজোট থেকে প্রার্থী ঘোষণা হলেই চূড়ান্তভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এদিকে দলের হেভিওয়েট অনেক প্রার্থীর স্থানেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এমনকি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রত্যাশিত ঢাকা-১৭ আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। রুহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন বাবলুর আসনেও দলীয় প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে জাপা সমর্থকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
এই ঘটনায় পার্টির চেয়ারম্যান নিজেও অস্বস্তিতে আছেন। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হচ্ছেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের। জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ অসুস্থ থাকায় তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলেও প্রচার করা হয়। তবে জিএম কাদের বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। পার্টির কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। আবার পার্টির মহাসচিবকেও দলের গুরুত্বপূর্ণ চিঠি স্বাক্ষরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে রেষারেষি চলছে বলেও কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।
মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে দল ত্যাগ : এদিকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছাড়াও কিছু সংসদ সদস্য প্রার্থিতার জন্য খোদ চেয়ারম্যান এরশাদ ও মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে টাকা দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে দলত্যাগ করতে শুরু করেছেন নেতারা। এর জেরে ফেনী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও পার্টির চেয়ারম্যানের যুব বিষয়ক উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার এরই মধ্যে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। বর্তমান এমপিসহ একাধিক প্রার্থী আছেন যারা প্রকাশ্যে জাপার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের বক্তব্য প্রচার হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে ফের তাদের ডেকে নিয়ে দল থেকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসন থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় জাতীয় পার্টি ছেড়ে মঙ্গলবার বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বিষয়ক যুগ্ম সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা শাখার সদস্য সচিব রোকনউদ্দিন বাবুল। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলুর হাতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনে এবার মনোনয়ন দেয়া হয় এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূইয়াকে। তিনি পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের উপদেষ্টা। অথচ তার শ্বশুর এ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে পরপর দু’বার এমপি নির্বাচিত হন। জিয়াউল হক মৃধা অভিযোগ করে বলেন, পার্টির মহাসচিব তাকে বঞ্চিত করে তার জামাতা রেজাউলকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অথচ এ এলাকায় রেজাউলের কোন পরিচিতি নেই, জনভিত্তিও নেই।
রেজাউল ইসলাম ভূইয়াকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছেÑ এ খবরে জিয়াউল হক মৃধার সমর্থকরা মঙ্গলবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বেলা সোয়া ১১টায় সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া মোড়ে এ কর্মসূচী পালিত হয়। ফলে মহাসড়কের দুই পাশের কয়েক কিলোমিটার তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভকারীদের সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর জিয়াউল হক মৃধা এসে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বলেন, মহাজোট থেকে রেজাউল ইসলামের বদলে যেন সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। অন্যথায় সরাইল-আশুগঞ্জে দুর্বার আন্দোলন হবে। দলের মনোনয়ন না পেয়ে বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন গাইবান্ধা জেলার সভাপতি আবদুর রশিদ। তিনি গাইবান্ধা-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের পদত্যাগের বিষয়টি জানান তিনি। আবদুর রশিদ বলেন, ‘গাইবান্ধা-২ আসন থেকে মনোনয়ন না পেয়ে আমি জাপা থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছি। বিএনপি থেকে মনোনয়নের চিঠিও পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি বারবার প্রতারিত হয়েছি। আমারও তো ভবিষ্যত আছে। রাজনীতি করতে গিয়ে বারবার প্রতারণার শিকার না হতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এরশাদের কার্যালয়ে তালা : এরশাদের বনানী কার্যালয় ঘিরে গত কয়েকদিন ধরেই মনোনয়ন বঞ্চিতদের বিক্ষোভ চলছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই কার্যালয়ে তালা দেয়ার খবর আসে। জানা গেছে, ক্ষুব্ধ সমর্থকরা দলীয় কার্যালয় ভাংচুর শুরু করলে জাপার হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে তালা দেয়া হয়। জানা যায়, ঢাকা-১৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু এরশাদের কার্যালয়ে বৈঠক করেছিলেন। তিনি জানান, তাকে মনোনয়ন না দেয়া হলে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করবেন।
এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অসুস্থতা নিয়ে আবারও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার রাতে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। তার প্রেস সচিব শুনিল শুভ রায় জানান, হাঁটু ব্যথাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন এরশাদ। চলতি মাসে এর আগেও অসুস্থতার কারণে সিএমএইচে ভর্তি ছিলেন তিনি। নির্বাচনের আগে এরশাদের অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে নানা আলোচনা-বিতর্কের জন্ম হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে এরশাদ সিএমএইচে। ফলে রহস্য দানা বাঁধছে। তবে এ গুঞ্জন-রহস্যের মধ্যেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন, তাদের দল প্রধান সুস্থ আছেন। তিনি অচিরেই হাসপাতাল ত্যাগ করবেন এবং চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে যেতে হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক প্রেসডিয়াম সদস্য বলেন, আসলে জাতীয় পার্টির সময়টা খারাপ যাচ্ছে। স্যারের (এরশাদ) বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে দলটির ভেতরে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে মনোনয়ন চিঠি বিতরণ, আসন বণ্টন, নির্বাচনের আগে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াসহ সবকিছু এলোমেলো চলছে। কেউ কোন দায়িত্ব নিতে চায় না। যে যার মতো দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে সমন্বয়ের অভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রহস্যজট তৈরি হচ্ছে।