কাজিরবাজার ডেস্ক :
এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে ৩৩ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা বেশিরভাগই অর্থনৈতিক। বিশেষ করে পণ্য রফতানি, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দেশের অবকাঠামো খাত উন্নয়নে দাতা সংস্থার সহযোগিতার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যাপক পস্তুতি নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এলডিসি উত্তরণ সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। জোর দেয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো এবং রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধিতে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজারের সন্ধান করা হচ্ছে। কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য। আগামী ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সূত্র মতে, স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসবে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে। এলডিসি হিসেবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এখন শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। তাতে রফতানি আয় ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবিসহ বড় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তির বিষয়টি সংকুচিত হয়ে আসবে। সহজশর্তের ঋণ আর পাওয়া যাবে না। এতে দেশের অবকাঠামো খাত উন্নয়ন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এলডিসি উত্তরণ হওয়ার পর জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এখন যে হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হয় তার চেয়ে বেশি হারে চাঁদা দিতে হবে। বেড়ে যাবে সরকারের ব্যয়। করোনার কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকা আমদানি এবং চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় এখন থেকে পস্তুতি নিতে ব্যর্থ হলে দেশের অর্থ ব্যবস্থায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে মনে করাছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে দেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। বড় অঙ্কের ঋণ ও অনুদানে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দর কষাকষির সুযোগ নেয়া যাবে। ক্রেডিট রেটিং বাড়বে বাংলাদেশের। বিশ্বের বড় বড় উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। বাড়বে কর্মসংস্থান এবং রফতানি আয়। উজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি। এসব ইতিবাচক দিক নিশ্চিত করতেই এখন থেকে পস্তুতি শুরু হয়েছে।
এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আরও পাঁচ বছর হাতে থাকায় অবশ্য পস্তুতি নেয়ার সময় পেয়েছে সরকার। নির্দিষ্ট ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীলের মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০১৮ এবং ২০২১ সালের পর্যালোচনায় তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে বের হয়ে সগৌরবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ন্যূনতম পাঁচ বছর সময় পাওয়া যাবে। এ সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও বাড়বে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমন্বিত করা হয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন : সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি বাজার উন্নয়ন, রফতানি বহুমুখীকরণ, স্থানীয় ওষুধ শিল্প, জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবসহ মোট ৩৩ ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে তালিকাভুক্ত করেছেন নীতি নির্ধারকরা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসকে প্রধান করে ২২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি রফতানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্যের ডিউটি ফ্রি এবং কোটা ফ্রি প্রবেশাধিকার এবং সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে বিদেশী ঋণ পাওয়ার বিষয়টি সংকুচিত হবে। এলডিসি হতে উত্তরণের ফলে বিভিন্ন সেক্টরে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানিয়েছেন, এ সাব-কমিটিকে আগামী এক মাসের মধ্যে সেক্টর ভিত্তিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে এবং কর্মপরিধি নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। এলডিসি হতে উত্তরণ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা হারাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণের পর ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি এ্যাকসেস এবং দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার বিষয় সংকুচিত হবে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে যাত্রা শুরু করে। ২০১১ সালের ৯ থেকে ১৩ মে জাতিসংঘের চতুর্থ এলডিসি বিষয়ক সম্মেলনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। সে সম্মেলনে ইস্তাম্বুল প্ল্যান অব এ্যাকশন গৃহীত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশকে এলডিসি হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে এ্যাকশন প্ল্যান নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশকে উন্নত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পায়।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল : এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বেশকিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে এলডিসি গ্রুপ স্বল্পোন্নত দেশ সংক্রান্ত সকল বাণিজ্য সুবিধা যাতে উত্তরণের পর ১২ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে, সে সম্পর্কে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছে। বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং এ প্রস্তাব যাতে গৃহীত হয় সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ দেশে জিএসপি প্লাস সুবিধা নেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ১১টি দেশের সঙ্গে পিটিএ এবং এফটিএ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভুটানের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে তাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর হবে। খাতভিত্তিক গবেষণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণের পর পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা থাকবে না। তাতে রফতানি আয় ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ ১২ গন্তব্য দেশের ৭০ শতাংশ রফতানি বর্তমানে বাণিজ্য সুবিধার অধীনে হচ্ছে। সেই সুবিধা না থাকলে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্যমতে, (সিপিডি) রফতানি আয় ৮-১০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার বা ২১ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রফতানি আয় কমবে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে কোন রফতানি খাতে কী ধরনের অভিঘাত আসবে, সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। যাতে পুরোপুরি পস্তুত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করা যায়। তিনি বলেন, এখনও পাঁচ বছর সময় আছে। এ কারণে ভাল পস্তুতি থাকা প্রয়োজন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, ২০২৬ সালের পর দেশ যেহেতু এলডিসির তালিকা থেকে বের হওয়ার গৌরব অর্জন করবে, তাই পলিসি গ্রহণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচিতি এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বিগত কয়েক বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপরে, এরপর তা ৭ শতাংশে এবং সর্বোচ্চ তা ৮ দশমিক দুই শতাংশে উন্নীত হয়েছে। করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি চার শতাংশে নেমে এলেও পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভাল রয়েছে। সামান্য কিছু দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা প্রত্যাশা : এলডিসি উত্তরণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বড় সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। চলতি সপ্তায় ইইউর সঙ্গে সচিব পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং ইইউ রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিংকের সঙ্গে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা যোগ দিবেন। রফতানির তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা ইইউভুক্ত ২৮টি দেশ। এছাড়া ইইউ করোনাকালীন সঙ্কটে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে উন্নয়নের জন্য ২০ কোটি ৫০ লাখ ইউরো, অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আগামী ৪ বছরের মধ্যে শিক্ষার মাধ্যমে জনশক্তি উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে মোট ২০ কোটি ৫০ লাখ ইউরো বা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এর মধ্যে ১৫ কোটি ইউরো প্রাথমিক শিক্ষা খাতে, কারিগরি শিক্ষা ৫ কোটি ইউরো এবং ৫০ লাখ ইউরো সংশ্লিষ্ট কারিগরি সহায়তা খাতে ব্যয় করার জন্য দিবে সংস্থাটি। একই সঙ্গে ইইউতে রফতানি বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। শ্রমমান ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭ শর্ত পরিপালনে সক্ষম হলে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশ-ইইউ যৌথ বাণিজ্য কমিশন জিএসপি প্লাস সুবিধার বিষয়ে শীঘ্রই একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হবে। রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম অধিকার ও কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া এ্যাকশন প্লানের ১৬ শর্ত পূরণ করা হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারির শতাধিক কমপ্লায়েন্স কারখানা স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়ে সকল শর্ত পূরণ করা হবে।