অবৈধ ও চোরাই পথে মোবাইল ফোন আমদানির বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাবে দেশে গত নয় মাসে এ খাতে বাজার কমেছে ১৭ শতাংশ। এ সময়ে লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদশে মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসয়িশেন (বিএমপিআইএ) মঙ্গলবার (২৭ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে স্মার্টফোনের স্থানীয় উৎপাদন পরবর্তী বাজার পর্যালোচনা (তৃতীয় প্রান্তিক-২০১৮) নিয়ে এক সংবাদ সংম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, দেশের উদ্যোক্তারা যখন মোবাইল ফোন উৎপাদন শুরু করেছে তখন এ কালোবাজারি চক্রের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে রয়েছে বিএমপিআইএ।
বিটিআরসি’র তথ্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে এ মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ সংখ্যা ১৫ কোটি ৫৮ লাখ। একই ব্যবহারকারী যেহেতু একাধিক সংযোগ ব্যবহার করেন তাই এর প্রকৃত সংখ্যা ৯ থেকে ১০ কোটির কাছাকাছি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বছর দেশে প্রায় তিন কোটি ৪৪ লাখ মোবাইল ফোন আমদানি হয়। ব্যবহৃত ফোনের প্রায় ২৫ শতাংশ স্মার্টফোন আর ৭৫ শতাংশ ফিচার ফোন। এ অনুপাতটিকে নানা চেষ্টার পরও উন্নত করা যাচ্ছে না। এর প্রাথমিক কারণ হলো ঢাকাসহ সারাদেশে দ্রুতগতির ও সুলভ মূল্যে মোবাইল ইন্টারনেটের অলভ্যতা, ইন্টারনেটে স্থানীয় ও উপযোগী বিষয়বস্তুর অভাব এবং জনগণের মধ্যে মোবাইল সেবাসমূহ সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব।
২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় সামগ্রিক বাজার কমেছে ১৭ শতাংশ (পরিমাণ) এবং ১১ শতাংশ (মূল্য)। ফিচার ফোনের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১৬ শতাংশ (পরিমাণ) ও ২০ শতাংশ। স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে এ হার ১৮ শতাংশ (পরিমাণ) ও ৭ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত নয় মাসে দেশে প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ মোবাইল ফোন আমদানি হয়েছে। অথচ গত বছরের একই সময়ে দেশে আমদানি হয়েছিলো দুই কোটি ৮০ লাখ মোবাইল ফোন। এর মধ্যে স্মার্টফোন আমদানি হয়েছিল ৬০ লাখ। চলতি বছর ৯ মাসে স্মার্টফোন আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ (১৭ শতাংশ কম)। ১০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কম মূল্যের স্মার্টফোনের (নিম্নমানের স্মার্টফোন) বিক্রি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যের স্মার্টফোনের বিক্রি প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে।
সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন জানান, বাজারের অধগতির একটি মূল কারণ অবৈধ ও চোরাই পথে মোবাইল ফোন আমদানির বিস্তার, তদারকি সংস্থার অপর্যাপ্ত নজরদারি ও অভিযান। রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত শপিংমলগুলোতে বহুসংখ্যক দোকান গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র এ চোরাই মোবাইল ফোনের যোগানের ওপর ভিত্তি করে। ফেসবুকসহ নানা অনলাইন পোর্টালেও এরা দোকান খুলে বসেছে।
চলতি বছরের বাজার পর্যালোচনা করে বলা হয়, বাজেট ঘোষণার পরপরই অবৈধ আমদানি কিছুটা বেড়ে যায়। মূলত স্মার্টফোনই অবৈধ পথে আমদানি হয় বেশি। অবৈধ পথে আসা এসব স্মার্টফোনের পরিমাণ বছরে আনুমানিক ২৫ লাখ। এর বাজারমূল্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এ অবৈধ আমদানির ফলে সরকার সরাসরি এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বর্তমানে আইফোন ও শাওমির সিংহভাগ পণ্য অবৈধভাবে এবং স্যাংমসাং ব্র্যান্ডের ৩৫ শতাংশ স্মার্টফোন ঢাকা, চট্টগ্রাম বিমান বন্দরসহ অন্যান্য বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে।
সংগঠনের সভাপতি বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মোবাইল ফোনের বাজার। এর আনুমানিক ৩০ শতাংশ অবৈধ হ্যান্ডসেটের দখলে। অবৈধ পণ্যের অনেকাংশই পুরোনো ফোন ‘রিফারবিশ’ এর মাধ্যমে দেশে আসছে। তাতে গ্রাহক প্রতারিত হচ্ছে এবং আমাদের প্রতিষ্ঠিত সেবা কেন্দ্রগুলো থেকে সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা চলতে থাকলে বৈধ আমদানিকারকরা ক্রমেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। সরকারের রাজস্বও ক্রমেই কমতে থাকবে।
স্থানীয় উৎপাদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওয়ালটন ও স্যামসাং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারে ছেড়েছে। কিন্তু তাদের উৎপাদন এখনও পর্যাপ্ত নয়। ভারতে এ মুহূর্তে তাদের বিক্রিত মোবাইল ফোনের ৯৪ শতাংশ হ্যান্ডসেটের যোগান দেয় স্থানীয় কারখানাগুলো।
বাংলাদেশের উদীয়মান সংযোজনকারীরা মোবাইল তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানিতে প্রায় ১৫-১৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করেন। কাজেই দেশে তৈরি ও সংযোজিত মোবাইল হ্যান্ডসেটও অবৈধভাবে আমদানিকরা হ্যান্ডসেটের সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।
বিএমপিআইএ সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া শহীদ অবৈধ পথে মোবাইল ফোন আমদানি কমানোর কার্যকরী উপায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় উৎপাদনকে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালার আওতায় নিয়ে এসে এ খাতকে প্রয়োজনীয় ছাড় দেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি ফোর জি নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি, কিস্তিতে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রির নীতিমালা অনুমোদনের দাবি জানানো হয়।