স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নগরী। সংঘাত-সংঘর্ষের আশংকা প্রকাশ করছেন অনেকেই। প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগে মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কয়েকদিনে একাধিক সংঘাতের ঘটনায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গতকাল রবিবার সকালে নগরীর টুলটিকরে আওয়ামী লীগের দলীয় মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত শনিবার রাতে নগরীর বাগবাড়ি এলাকায় এতিম স্কুল রোডে ৯ নং ওয়ার্ডের এক লাঞ্ছিত হয়েছেন সাংবাদিক আরিফ।
এসবের বাইরে নির্বাচনের প্রচারকাজের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত-শিবির হয়ে উঠছে মারমুখী। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর একাধিকবার হামলা করেছে তারা। সর্বশেষ শুক্রবার জামায়াতের সশস্ত্র হামলার মুখে পড়েন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরীর ভগ্নিপতি ও তাজ ট্রাভেলসের স্বত্ত্বাধিকারী হাসান আবদুল গণি।
এদিন নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুবিদবাজার জামে মসজিদের ভেতর মেয়র প্রার্থী জামায়াতের মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের নির্বাচনী লিফলেট বিতরণ করছিল দলটির কয়েকজন নেতাকর্মী। এ সময় হাসান আবদুল গণি তাদের মসজিদের বাইরে গিয়ে লিফলেট বিলি করতে বলেন। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তারা। এ ঘটনার কিছু সময়ের মধ্যে শিবির ক্যাডাররা মুখোশ পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কয়েকটি মোটরসাইকেলে এসে তাঁর ওপর চড়াও হয়। এ সময় তিনি প্রাণ বাঁচাতে পাশের মহানগর যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন মৌরশী রেস্টুরেন্টে আশ্রয় নেন। তাঁকে না পেয়ে দুর্বৃত্তরা রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর চালায়। প্রকাশ্যে এ ধরনের হামলায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আশপাশের ব্যবসায়ীরাসহ সাধারণ মানুষ। এর কয়েক দিন আগে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আলম খান মুক্তির ওপরও শিবির হামলা চালায় বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতারা। অল্পের জন্য সেদিন শিবিরের হামলা থেকে বেঁচে যান ওই যুবলীগ নেতা।
জানা গেছে, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খানের লিফলেট ওপরে রেখে জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের লিফলেট বিতরণ করছিল শিবির সদস্যরা। ওই সময় মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আলম খান মুক্তি সেই লিফলেট নিতে অস্বীকার করা নিয়ে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে শিবির ক্যাডাররা মুহূর্তের মধ্যে জড়ো হয়ে তাঁর ওপর হামলা চালায়। এ সময় তিনি দৌড়ে নিজ বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পান।
সিলেট মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ হান্নান বলেন, মসজিদের ভেতরে লিফলেট বিলির প্রতিবাদ করায় এ হামলা চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। দ্রুত সময়ে তাদের ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হওয়া এবং হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে তাদের ভালো প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন, হামলার শিকার আবদুল গণি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও আমার হোটেলে ভাঙচুর করা হয়েছে। হামলার ভিডিও ফুটেজ থানায় সরবরাহ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর প্রার্থী আফতাব হোসেন খান বলেন, আমার ওয়ার্ডে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা নিন্দনীয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে প্রচুর অপরিচিত লোক মহানগরীতে আসছে বলে আমাদের কাছে খবর আছে। নগরীর বিভিন্নস্থানে হামলার ঘটনার পর থেকে এখানকার ভোটারদের মধ্যে সংশয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ ব্যপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমি বুঝতে পারছি না এসব কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে। এসব কারণে ক্রমেই নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। সুষ্ঠু পরিবেশের নির্বাচন আমরা সবাই যে আশা করছি, তা বিঘিœত হবে। এখনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর হওয়া উচিত বলে মনে করছেন এই নেতা। তিনি বলেন, দাগি আসামি, পলাতক আসামি যদি থেকে থাকে, তারা যে দলেরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
নগরীর সুবিদবাজারে হামলাকারীদের সঙ্গে ট্রাভেল ব্যাগ থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যাগ নিয়ে এভাবে চলাফেরা করা তো সন্দেহজনক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। এসব তো মানুষকে আস্তে আস্তে আতঙ্কগ্রস্ত করছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, আমি আসলে এসব ঘটনার বিষয়গুলো সত্যি বলতে জানি না। তবে নির্বাচনে যারাই প্রার্থী হয়েছেন তাদের সবার উচিত আমাদের সম্মানিত ভোটারদের ওপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সহযোগিতা করা। এমন কিছু করা সঠিক হবে না, যাতে নির্বাচনের পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর নেতাকর্মীকে ধরপাকড়সহ নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। প্রতিদিনই পুলিশ কোনো না কোনো বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে দক্ষিণ সুরমার ঝালপাড়া থেকে রাসেল ও সুমন নামের দুই কর্মীকে আটক করে নিয়ে গেলেও পুলিশ স্বীকার করেনি। ওই ঘটনার পর প্রার্থীসহ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিএনপির নেতাকর্মীরা। আটক কর্মীদের সন্ধানের দাবিতে শনিবার দুপুরে মেয়র প্রার্থী আরিফুল হকসহ শতাধিক নেতাকর্মী মহানগর পুলিশের উপ কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করা হলে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে প্রচারণায় চলে যায় তারা। শুধু দুই কর্মীই নয়, কয়েক দিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বাড়িতে অভিযানও চালায় পুলিশ। এ অবস্থায় নির্বাচনী মাঠ যেন ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করছে নগরবাসী।
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, আমাদের চার-পাঁচজন নেতাকে ধরে নিয়ে এলো। তাদের ওপর কোনো ওয়ারেন্ট নেই, মামলা নেই। তারা তো রাজনৈতিক কর্মীও না। একেবারে সাধারণ, ইলেকশন এলে কাজ করেন। তাদের ধরে আনার মানে আমাদের নির্বাচনী কাজে বাধা সৃষ্টির জন্য আতঙ্ক তৈরি করা। তিনি আরো বলেন, আমাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো মিটিং-মিছিল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা একটা বড় রাজনৈতিক দল হলেও নির্বাচনী কাজে বাধা দেওয়া হয়। অথচ জামায়াত নির্বিঘেœ সব কাজ করে যাচ্ছে, তাদের পুলিশ কোনো হয়রানি করে না। এটা কিসের ইঙ্গিত? বিএনপির আরেক নেতা জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেন, কয়েকটা জায়গায় আমি নিজেই দেখেছি তাদের কর্মীরা কাজ করছে, যাদের বেশির ভাগই বাইরের লোক। কেউ বিশ্বনাথ, কেউ কানাইঘাট, কেউ অন্য অঞ্চল থেকে এসে কাজ করছে। তারা অনেক মামলার আসামি। হয়তো জামিনে আছে, কিন্তু তারা দিব্যি কাজ করে বেড়াচ্ছে। তাদের সরকার কোনো বাধা দিচ্ছে না।
হামলার ঘটনা অস্বীকার করে মেয়র প্রার্থী জামায়াতের মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমার কর্মীরা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। তার পরও বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।