॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ চলছে দানবীয় রাজত্ব। শৃংখলিত মানবতা প্রহর গুণছে মুক্তির। কিন্তু মুক্তি পরিবর্তে সৃষ্টি হচ্ছে নব নব সংকট। বাড়ছে অশান্তি। মরছে বনী আদম। ধ্বংস হচ্ছে জনপদ। ঠিক এমনি এক সমস্যা সংকুল পরিবেশে অজ্ঞানতা, অমানবিকতা, নির্লজ্জতা ও হিংস্রতার অক্টোপাশে আবদ্ধ মানব সভ্যতাকে রাহুমুক্ত করার এবং নতুন জীবনদানের অঙ্গীকার নিয়ে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এ পৃথিবীতে এসেছিলেন বিশ্ব মানবতার মহান শিক্ষক মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.)। তাঁর সম্পাদিত মহাবিপ্লব সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে আজও এক বিস্ময়। সমগ্র বিশ্বের অকৃত্রিম দরদীবন্ধু ও অভিভাবক- এ মহান ব্যক্তিত্বের অতুলনীয় দর্শনের স্পর্শে অভিভূত হয়েছিল সমকালীন সমাজ ও পৃথিবী। কুরআনের ভাষায় তার সূর্যের মত উজ্জ্বল এবং চন্দ্রের মত স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে স্থান-কাল নির্বিশেষে গোটা মানবসভ্যতা। অথচ পবিত্র কুরআনে মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করে বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। মহানবী (সা.) এর হাদীসে রয়েছে, মানবাধিকারের অসংখ্য উদাহরণ। ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রবন্ধে মানবাধিকারের পরিচয়, পরিধি, মহানবী (স.) এর গৃহীত পদক্ষেপ এবং বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকারের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
মানবাধিকার ও প্রাসঙ্গিক কথা : আধুনিক বিশ্বে মানবাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয়। মানবাধিকার বলতে সরলার্থে মানুষের সহজাত অধিকারই মানবাধিকার হিসেবে পরিচিত। যে সব মানবিক অধিকার ব্যতীত মানুষ পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে মর্যাদাসহ জীবনধারণ করতে পারে না, মানবিক গুণাবলি ও বৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না সাধারণত সেগুলোই মানবাধিকার হিসেবে গণ্য। “রহমান, মুহাম্মদ মতিউর, “ইসলামে মৌলিক মানবাধিকার” ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল-জুন, ২০০৩, পৃ. ৩৩”। যুগে-যুগে দেশে-দেশে বিত্তবান, ক্ষমতাধর শাসক শ্রেণী কর্তৃক দুর্বল, ক্ষমতাহীন, বিত্তহীন জনগোষ্ঠী শোষিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে। এ শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহ অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেন যাঁদের প্রত্যেকেই দানবরূপী শাসক শ্রেণী কর্তৃক অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহর নবীগণের সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরও স্বৈরাচারী, দাম্ভিক শাসক শ্রেণী সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকারে কুঠারাঘাত করছে, বিশ্বমানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করছে, নির্বাসিত করেছে শান্তি-সমৃদ্ধিকে। তাই চরম উপেক্ষিত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষগুলো বাধ্য হয়ে তাদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
মানবাধিকার সম্পর্কে তদানীন্তনকালের ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবী সর্বপ্রথম খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ২১৩০-২০৮৮ সালে ‘ব্যাবিলনীয় কোড বা ‘হামুরাবী কোড’ এর মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টিকে আইনগত রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। “রেবা মন্ডল ও মো. শাহজাহান মন্ডল, মানবাধিকার আইন-সংবিধান ইসলাম, চট্টগ্রাম: ১৯৯৯, পৃ. ৪”। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে মহানবী (সা.) মানুষকে আল্লাহর খলীফা অভিধায় অভিহিত করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন অতঃপর তিনি আল-কুরআনের নির্দেশনা এবং স্বীয় বাণী, কর্ম ও অনুমোদনের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, বিশ্বেও ইতিহাসে তা বিরল। “ড. আ.ক.ম আব্দুল কাদের, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (স.) প্রেক্ষিত বর্তমান বিশ্ব, আত্-তাকবীর, চট্টগ্রাম: সীরাতুন্নবী সংখ্যা ৮, ২০০২, পৃ. ৪৭”।
মানবাধিকার ও শাব্দিক পরিচিত : ‘মানবাধিকার’ শব্দটি অধুনাবিশ্ব প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত বিষয়। এটা একটি যৌগিক শব্দ যার ইংরেজী পরিভাষা হল “ঐঁসধহ জরমযঃং”. “ঐঁসধহ ৎরমযঃং” – এর পরিচয়ে কোথাও বলা হয়েছে- ঙহব ড়ভ ঃযব নধংরপ ৎরমযঃং ঃযধঃ বাবৎুড়হব যধং ঃড় নব ঃৎবধঃবফ ভধরৎষু ধহফ হড়ঃ রহ পৎঁধষ ধিু, বংঢ়বপরধষষু নু ঃযবরৎ মড়াবৎসসবহঃ দদঅ.ঝ ঐড়ৎহনু, ঙঢঋঙজউ অউঠঅঘঈঊউ খঊঅজঘঊজ’ঝ উওঈঞওঙঘঅজণ. খড়হফড়হ: ঙীভড়ৎফ টহরাবৎংরঃু চৎবংং, ঝরীঃু ৎফ, ২০০২, ঢ়. ৬৩৫’’ এটি মূলত ফরাসী শব্দ হতে উৎপন্ন। অর্থ হল- মানুষের অধিকার “আব্দুন নূর, বিশ্বমানবাধিকার ঘোষণা, ইসলাম ও গণতন্ত্র, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক ফোরাম কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ১৯৯৪ সালে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ, পৃ. ১”। ঞযড়সধং চধরহব সর্বপ্রথম ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদ কর্তৃক ১৭৮৯ সালে গৃহীত জরমযঃং ড়ভ গধহ ঘোষণার জন্য উৎড়রঃং ফব খ’যড়সব শব্দটি ব্যবহার করেন যা গৎং. ঊষপধহড়ৎ জড়ড়ংবাবষঃ- এর প্রস্তাব অনুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং এ ঐঁসধহ জরমযঃং বা মানবাধিকার পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। “ঞযড়সধং ড. ডরষংড়হ, অ ইবফৎড়পশ ঈড়হংবহংঁং ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃ’ং ওহ ঐ. ঐবহশরহ (বফ). ঐঁসধহ উরমহরঃু: ঞযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষুধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃ: ১৯৭৯, চ.৪৮’’ যার আরবী পরিভাষা “ইক্ব বা হুকুক” যা কুরআন-সুন্নাহে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মানবাধিকার পরিভাষাটি কখনো ইধংরপ ঐঁসধহ জরমযঃং, কখনো ঋঁহফধসবহঃধষ জরমযঃং আবার কখনো ইরৎঃয জরমযঃং ড়ভ ঐঁসধহ নবরহম ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়। “ড.আ.ক.ম. আব্দুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮”।
মানবাধিকার-এর বিকাশ : মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ধন-সম্পদ, জেন্ডার নির্বিশেষে সমভাবে দেখে তার সহজাত ও ¯্রষ্টা প্রদত্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাই হচ্ছে ‘মানব মর্যাদা’। মানুষের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষা, সহজাত ক্ষমতা ও প্রতিভার সৃজনশীল বিকাশ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কতিপয় অধিকার স্বত্বই হচ্ছে মানবাধিকার। “হাসান, ড. মোস্তফার, মানবাধিকার ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) একটি পর্যালোচনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৪৭ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল- জুন, ২০০৮, পৃ. ৪৪”। মানুষের এই অধিকার তার জন্মগত এবং মানবিক মূল্য মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট। ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহহরপধ- তে মানবাধিকারকে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত মানুষের জন্মগত অধিকার দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “জরমযঃং ঃযড়ঁমযঃ ঃড় নবষড়হম ঃড় ঃযব রহফরারফঁধষ ঁহফবৎ হধঃঁৎধষ ষধি ধং ধ ঈড়হংবয়ঁবহপব ড়ভ যরং নবরহম যঁসধহ’’ দদঞযব ঘবি ঊহপুপষড়ঢ়ঁবফরধ ইৎরঃঁহহরপধ, টঝঅ: ঋঁহফবফ রহ ১৭৬৮, ১৫ঃয বফরঃরস, ঠঙখ-৫, চ, ২০০’’। (সমাপ্ত)