স্পোর্টস ডেস্ক :
বিশ্বকাপের একবিশংতম আসরের ফাইনাল আজ। স্বপ্নের শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে ক্রোয়েশিয়া। কারা হাসবে শেষের হাসি? ১৯৯৮ সালের পর আবারও বিশ্বসেরার মুকুট পড়বে ফ্রান্স নাকি নতুন চ্যাম্পিয়ন পাবে রাশিয়া বিশ্বকাপ? ইতিহাসের প্রথম ট্রফি জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাসবে ক্রোয়েশিয়া! তা জানার জন্য গোটা ফুটবল দুনিয়ার ভক্ত-অনুরাগীরাই উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল। বিটিভি, মাছরাঙা এবং নাগরিক টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে ম্যাচটি।
বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দুর্দান্ত খেলেছে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া। গ্র“প পর্ব থেকে শুরু করে, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা শেষ চার-সর্বত্রই নিজেদের সেরা পারফর্মেন্স উপহার দিয়েছে দল দুটি। ফ্রান্সের গতির কাছে উড়ে গেছে টুর্নামেন্টের ফেবারিট আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে কিংবা বেলজিয়ামের মতো দল। কিলিয়ান এমবাপে-এ্যান্টনি গ্রিজম্যানদের মতো তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের পারফর্মেন্সে মুগ্ধ-বিমোহিত হয়েছে ফুটবল দুনিয়া। রাশিয়া বিশ্বকাপে আলাদা করে নজর কেড়েছে ক্রোয়েশিয়াও। প্রথম বিশ্বকাপ খেলার বিশ বছর পর প্রথমবার টুর্নামেন্টের ফাইনালেও জায়গা করে নেয় তারা। ক্রোয়েশিয়ার এমন পারফর্মেন্সের পেছনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন লুকা মডরিচ, ইভান রাকিটিচ কিংবা মারিও মানদুকিচের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা। যে কারণেই আজ তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে রোমাঞ্চকর এক ফাইনালই দেখা যাবে বলে মনে করছেন ফুটবলবোদ্ধাদের অনেকে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে অভিষেক ঘটেছিল ক্রোয়েশিয়ার। সেই আসরেই বাজিমাত করেছিল দলটি। শুরু থেকে সেরাটা ঢেলে দিয়ে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল বলকান অঞ্চলের দেশটি। দুই দশক পর এবার নিজেদের অতীত সাফল্যকেও ছাড়িয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। মডরিচ-মানদুকিচদের সামনে এখন নতুন ইতিহাস গড়ার হাতছানি। ২১তম বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার আগে তৃতীয় স্থানই ছিল তাদের সর্বোচ্চ অর্জন। আজ ফ্রান্সকে হারালেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়বে ক্রোয়েশিয়া। রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে উঠে আসাটাকে রূপকথা বলছেন অনেকেই। তবে দারুণ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই অবস্থনে পৌঁছেছে দলটি। সেইসব বৈশিষ্ট্যের কারণে এবারের বিশ্বকাপও নিজেদের ঘরে তুলতে পারেন ক্রোয়েটরা বলে মনে করছেন অনেকে।
এবারের আসরে ক্রোয়েশিয়ার এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে দলের ভেতর বিস্ময়কর বোঝাপড়া ও উদ্দীপনা। শেষ তিনটি ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে জিততে হয়েছে তাদের। কঠিন সময়েও নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়া, ঐক্য ও উদ্দীপনায় এক চিলতে ফাটল ধরেনি। মানসিক শক্তি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও আলাদা করে ভূমিকা রেখেছে তাতে। ক্রোয়েশিয়ানদের কামব্যাকের সেসব ম্যাচে তাদের মানসিক শক্তির চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে। শারীরিক ভাষাতেও তা ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। অধিনায়ক লুকা মডরিচ তো বারবার বলেছেন, আমরা আমাদের বৈশিষ্ট্যটাকেই ফুটিয়ে তুলেছি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালেও ক্রোয়েটদের ব্যক্তিত্বের এই শক্তির দিকটিই বড় অস্ত্র হবে। তাছাড়া অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসও চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে তাদের। ক্রোয়েশিয়ার এই সোনালি প্রজন্মের নেতা মডরিচ। শুধু রিয়াল মাদ্রিদের এই খেলোয়াড়ই নয়, এই দলে আছে বিশ্বের বড় বড় ক্লাবে খেলা বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়। দলের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ২৭ বছর ১০ মাস। দলটিতে অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস যেন একসূত্রে গাঁথা। ফ্রান্সের বিপক্ষে জিতে ইতিহাস গড়ার পথে যা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দলের কোচ জøাতকা দালিচও দারুণ আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘এটি জীবনের সবচেয়ে সেরা সুযোগ। এটি আমাদের জন্য কঠিন হয়েছে কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা শক্তি ও প্রেরণা খুঁজে পাব। আমরা কঠিন পথে ছিলাম। সম্ভবত আমরাই বিশ্বকাপে একমাত্র দল চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতে আমাদের আটটি ম্যাচ খেলতে হয়েছে, যদি সব মিনিট একত্রিত করা হয়।’
এদিকে, ফ্রান্সও দ্বিতীয় শিরোপা জিততে মরিয়া। এই নিয়ে টানা দ্বিতীয় মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলছে দিদিয়ের দেশমের দল। ২০১৬ সালে নিজেদের মাটিতে ইউরো ফাইনাল খেলেছিল এমবাপে-গ্রিজম্যানরা। কিন্তু সেবার পর্তুগালের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ডুবে অঁরি-জিদানের উত্তরসূরিরা। সেই স্মৃতি ভুলে ফরাসীরা এবার নতুন ইতিহাস লিখতে চায়। অলিভিয়ের জিরুড তা সুস্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। তার মতে, ‘এবারের অনুভূতিটা একরকম নয়। আমরা জানি যে, আমাদের আরেকটা ম্যাচ জিততে হবে। এবার আমাদের মনোসংযোগ ও চিন্তা কাজটা শেষ করা নিয়ে। এ জন্যই পরিস্থিতি আলাদা। আমরা এই পর্যন্ত আসতে লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছি। এখন এই সুযোগটা নষ্ট করতে চাই না।’ এ সময় নিজেদের অসাধারণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের পাশাপাশি নিজের পারফর্মেন্সের কথাও সামনে এনেছেন জিরুড, ‘আপনি শুধু প্রতিভা দিয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারবেন না। শুধু প্রতিভা যথেষ্ট হবে না। আপনার কার্যকারিতা লাগবে। মানসিক শক্তি এই ম্যাচে শতকরা ৭০ ভাগ ভূমিকা রাখবে। আপনি যদি আপনার সতীর্থদের সঙ্গে কাজ করতে তৈরি থাকেন, পরস্পরের সঙ্গে একই নিবেদন দেখাতে পারেন এবং প্রতিজ্ঞা ঠিক রাখেন, তাহলে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে আমার কার্যকারিতার অভাব ছিল। সেই সাথে স্কোর করার জন্য যে ভাগ্যটা দরকার হয়, সেটাও ছিল না। আশা করি ফাইনালে ভাগ্য আমার সঙ্গে থাকবে। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং যথেষ্ট পরিশ্রম করছি। আমাদের মূল ব্যাপারটা হলো, সকলে যার যার সেরাটা ঢেলে দেয়া।’
দলের তরুণ ফুটবলার ব্লেইস মাতুইদি বিশ্বকাপের ফাইনালকে স্বপ্নের ম্যাচ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপের ফাইনাল, শৈশবের একটি স্বপ্ন সত্য হতে চলেছে। আমরা শিরোপার খুব কাছে, আমরা সেটি স্পর্শ চাই। এটিই আমাদের জীবনের খেলা।’ দুই বছর আগে পর্তুগালের কাছে হারের দুঃস্মৃতি মনে করে মাতুইদি এ সময় আরও বলেন, ‘ওই হার থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি এবং এর মানে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে ফাইনাল খেলতে হয়।’
এই বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের পাশে বসার সুযোগ ফ্রান্সের সামনে। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলের অধিনায়ক ছিলেন দিদিয়ের দেশম। এবার তিনি দেশটির কোচ। আজ ফাইনালে যদি ফ্রান্সকে হারাতে পারেন তাহলে অনন্য এক রেকর্ড গড়বেন দেশম। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়বেন তিনি। এর আগে ব্রাজিলের মারিও জাগালো ও জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার এমন কীর্তি গড়েছিলেন।