কাজিরবাজার ডেস্ক :
পবিত্র মাহে রমজানের আজ ১৪ তম দিবস। মহান আল্লাহ পাক এ পবিত্র মাসে দিনের বেলায় আমাদের জন্য সিয়াম ফরজ করেছেন। আর নবী হযরত রাসূলে কারিম (স.) রাতের ভাগে আমাদের জন্য তারাবিহ নামাজকে সুন্নত করেছেন। এ নামাজের ফজিলত ও তাৎপর্য অনেক। এটি পবিত্র মাহে রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিখ্যাত হাদিস সঙ্কলন নাসায়ি শরিফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলে মাকবুল (স.) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি ঈমানি প্রেরণা ও সাওয়াবের উদ্দেশে এ মাসে রোজা রাখবে এবং নামাজ পড়বে সে ব্যক্তি গুনাহ হতে এ রূপ মুক্ত হবে যেন আজই তার জননী তাকে প্রসব করেছে।
আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ কুদরত যে, তিনি মুসলমানদের হৃদয়ে সারা দিনের সিয়াম সাধনার পর তারাবিহ সালাতকেও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার জন্য অফুরন্ত উৎসাহ উদ্দীপনা দান করেছেন। তারাবিহ নামাজের প্রতি যুগে যুগে মুসলিম জাতি যে গভীর দরদ ও প্রেমের পরিচয় দিয়ে এসেছে তার তুলনা ধর্মের ইতিহাসে মেলা ভার। এটি হলো হুব্বে দ্বীন ও হুব্বে রাসূলের পরিচয়।
বস্তুত; বহু প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থেই রাসূলুল্লাহ (স.) এর ইমামতিতে সালাতে তারাবিহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। তবে একাধারে তিনদিন জামাতের সঙ্গে তারাবিহ আদায়ের পর জামায়াত অনুষ্ঠান থেকে তিনি বিরত হন। কেননা তার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, হয়তো এটা ফরজ করে দেয়া হবে আর উম্মতের জন্য তা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর হযরতের (স.) ওপর লাখো দরুদ ও সালাম, তিনি এ নামাজের গুরুত্ব ও উম্মতের সুবিধা আর কল্যাণ বিবেচনা করে একে সুন্নাত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। হযরত রাসূলে কারিম (স.) এর ওফাতের মাধ্যমে যখন ওহির যুগের সমাপ্তি ঘটলো তখন সাহাবাগণ সর্বসম্মতভাবে তারাবিহর জামায়াত শুরু করলেন। বলা বাহুল্য, সালাতে তারাবিহের বিষয়েও তারা তাদের নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই তো আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট।
সাহাবা-পরবর্তী যুগের উম্মাতগণেও এ ফজিলতময় ইবাদতের হিফাজত ও সংরক্ষণের বিষয়ে অত্যাধিক যতœবান ছিলেন। এমনকি এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত তথা হকপন্থীদের বৈশিষ্ট ও প্রতীকরূপে স্বীকৃতি লাভ করল। আমরা যেহেতু সালফি সোয়ালিহীন তথা পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণের উত্তরাধিকারের গর্বিত দাবিদার, তাই আমাদের উচিত মর্যাদা বৃদ্ধিকারক সালাতুত তারাবিহ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে জারি ও কায়েম রাখা। এ পবিত্র নামাজ আমাদের পরকালীন নাজাত ও মুক্তির জন্য যেমন সহায়ক হবে, তেমনি এর চর্চা ও শিক্ষা আমাদের পার্থিব জীবনে একতা, শৃঙ্খলাবোধ ও পারস্পরিক হামদর্দির পথ প্রশস্ত করবে।
তারাবিহ নামাজে কুরআন খতমের বিষয়টি এক বড় ধরনের নিয়ামক শক্তি। বর্তমানে মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি, মুসল্লিদের রুচি ও আভিজাত্য বৃদ্ধি এবং কুরআন শরিফ হিফজকারী বা হাফিজদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে তারাবিহ নামাজে বেশ নতুনত্ব সৃৃষ্টি হয়েছে।
শীতের মৌসুমে যেমন অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে তেমনি রমজানের আগ মুহূর্তে খতমে তারাবিহ পাওয়ার মানসে নগরীতে সংঘটিত হতে থাকে কুরআনে হাফিজগণ। বর্তমানে মসজিদের সংখ্যার তুলনায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে হাফিজ সাহেবদের সংখ্যা। ফলে ক্রমান্বয়ে বেকারত্বের দিকে যাচ্ছে হাফিজ সাহেবগণ। মাহে রমজানে খতম তারাবিহ পড়ানোর সুযোগ না পেয়ে দেদার হাফিজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এ ব্যাধি এক সময় ধর্মীয় ও সামাজিক বিপর্যয় আনবে, কুরআন মুখস্থকরণে নিরুৎসাহিত হবেন। এ ক্ষেত্রে আমি প্রথমে হাফিজ সাহেবদের উদ্দেশে বলব, বর্তমান আধুনিক যুগ, বিজ্ঞানের যুগ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণের যুগ। এ ক্ষেত্রে শুধু কুরআন মুখস্থ করে সারা বছর খতম তারাবিহের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। অন্যান্য হাতের কাজ আয়ত্ত করুন, তাহলে সারা বছরের হতাশা কেটে বুকভরে আশার সূর্য উদিত হবে। মাদ্রাসা কলেজ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিন, ব্যবসা -বাণিজ্যে মনোযোগ দিন, অনুবাদ শিল্প, কম্পিউটার, টেলিফোন ফ্যাক্সসহ টেকনিক্যাল বিষয় সমূহ আয়ত্ত করুন।
আমাদের উচিত হাফেজ সাহেবদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া এবং তাদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির দিকে সুনজর দেয়া, যাতে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা বা হাফেজ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ থাকে। একই সঙ্গে মসজিদ কর্তৃপক্ষকেও শুধু ২ জন হাফেজ না রেখে ৩/৪ জন হাফেজ সাহেবকে খতম তারাবিহ জামাতে স¦াগত জানানোর জন্য আহ্বান জানাব। খতম তারাবিহ শুদ্ধতার দিকেও মনোযোগী হতে হবে আমাদেরকে। বস্তুত, কুরআন নাজিলের পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত রমজানে ত্রিশ দিনব্যাপী তারাবিহ নামাজ পড়া যেমন সুন্নত, তেমনি এ মাসব্যাপী তারাবিহতে কুরআন খতম করাও সুন্নত। অবসরে যারা কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না বা কুরআন পড়তে জানে না তাদের জন্য তারাবিহতে খতম শোনা, সর্বোপরি পবিত্র নামাজে সকলে সুললিত কণ্ঠে গোটা কুরআন শোনা অত্যন্ত জরুরী ও সুখকর বিষয়। এ সময় যারা আরবি ভাষায় পারদর্শী তারা আয়াতের মর্ম অনুধাবনেও সক্ষম হয়। অবশ্য এ জন্য চাই যোগ্য হাফেজ ও প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ।
পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষী ও কুরআন বিশেষজ্ঞগণ সমস্ত কুরআনকে পাঁচশত চল্লিশ রুকু নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কুআনের কপিতে দেয়া এ চিহ্ন মোতাবেক ২৭তম রাতে অনায়াসে কুরআন খতম সম্ভব।- (ফ. আলমগীরী, আরকানে আরবায়া)। আমাদের দেশে কিছু কিছু মসজিদ আছে যেখানে এর চেয়ে কম সময়ে এক রকম তাড়াহুড়োর মাধ্যমে খতম তারাবিহ শেষ করা হয়। এতে যেমন কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায় না; তেমনি গুনাহ হওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা থাকে। হাদিসে এসেছে- রুব্বা ক্বা-রিন ইয়াকরায়ূল কুরআনা ওয়াল কুরআনু ইয়াল আনুহু- এমন কতিপয় ক্বারী আছে, যারা কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ কুরআন তাদের লা’নত দেয়। ‘সূরা মুজ্জাম্মিলে বর্ণিত হয়েছে- তোমরা কুরআন আবৃত্তি কর সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে।’ এ আয়াতে বর্ণিত ‘তারতিল’ শব্দের অর্থ সহজ ও সঠিকভাবে বাক্য উচ্চারণ করা। (মুফরাদাত)।
একইভাবে কতিপয় মুসল্লি হাফেজ সাহেবের দীর্ঘ তিলাওয়াতের সময় অহেতুক গল্প গুজব ও আরাম বিশ্রামে মত্ত থাকে। যা ধৃষ্টতার শামিল। এ আচরণও মোটেই শোভনীয় ও গ্রহণীয় নয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক….।’- (৭: ২০৪)। সুতরাং আমাদের আরজ হলো, কুরআনের বরকত হাসিলের এই মৌসুমে আমরা যেন কোনভাবে নানা অজ্ঞতাবশত পবিত্র কিতাবের গজব পাওয়ার হকদার হয়ে না বসি।