কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আগামী ৮ ফেব্র“য়ারি রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তিন পর্যায়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। এই রায়কে ঘিরে দলীয় অবস্থান থেকে সতর্ক রয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগও। একইভাবে পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতা নিচ্ছে রায়কে ঘিরে। এছাড়া সরকারের প্রশাসনও থাকবে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায়। রায়কে কেন্দ্র করে কোনও ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ে। গোয়েন্দা সংস্থাও আগে থেকেই প্রস্তুত রয়েছে।
পুলিশ প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার ফেরার পথে আটক দুই কর্মীকে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান বিএনপিকর্মীরা। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বিষয়টি।
রায়ের পর সহিংসতার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ের পর কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী জানিয়েছেন, জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার্থে সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থাকবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘রায়-পরবর্তী সরকারের যা করণীয়, সবটাই করব। দেশের মানুষের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। একটি নিশ্চিন্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করার, সবই করা হবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বিএনপি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কোনও কর্মকাণ্ডে নেই। তাদের আচরণে প্রমাণ হয়েছে এটি একটি সন্ত্রাসী দল। তারা যদি কোনও নাশকতা বা অরাজকতার চেষ্টা করে তাহলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।’
ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সহিংসতার চেষ্টাকারীদের প্রতি কঠোর অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের বার্তাও দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপি যেনও রাজধানীর কোথাও জমায়েত হতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করারও নির্দেশনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সতর্ক অবস্থান নেবে রায়ের দিন। বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন কোথাও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, তা নজরদারিতে রাখবেন দলীয় নেতাকর্মীরা। রাজপথ যেন বিএনপি দখলে নিতে না পারে, সে ব্যবস্থাও নেবে আওয়ামী লীগ।
শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশের কোথাও রায়কে কেন্দ্র করে কোনও ধরনের নাশকতা সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে মাঠপ্রশাসনও সতর্ক থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশপাশি সরকারি প্রশাসন থাকবে সতর্ক অবস্থানে।
যেকোনও ধরনের নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র্যাবসহ জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। যেকোনও ধরনের নাশকতা রোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে মিটিং করে সংশ্লিষ্টদের করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। শুধু জেলা নয়, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন-পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। কোনও ধরনের অপতৎপরতা সহ্য করা হবে না।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহম্মদ আলী হোসেন জানান, ‘শুধু ৮ ফেব্র“য়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করেই নয়, যেকোনও সময় জেলায় কোনও ধরনের নাশকতা বরদাশত করা হবে না। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। পর্যটনের কারণে কক্সবাজার জেলা এমনিতেই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুটি যুক্ত হয়েছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কক্সবাজার আসছেন। তাই এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় জেলা প্রশাসনসহ ও সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি রয়েছি।
এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মাছুমুর রহমান বলেন, ‘৮ ফেব্র“য়ারি বরিশালে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দিন তিনি পটুয়ালীতে সেনানিবাসসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। কোনও ধরনের নাশকতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি যেন না হয়, সেদিকে তৎপর রয়েছি।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এম এ মান্নান বলেন, ‘বিশেষ কোনও নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ সব সময়ই থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’
এদিকে এই মামলার রায়কে কেন্দ্র করে যেন কোনও রকমের নাশকতার ঘটনা না ঘটে সে জন্য পুলিশ সুপারদের (এসপি) সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এছাড়াও পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক করণীয় নিয়েও বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে এসপিদের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে আশঙ্কা করা হয়েছে, পুলিশ ও সরকারি স্থাপনায় হামলা হতে পারে। এছাড়া পরিবহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলপথে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে পুলিশ সদর দফতর।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলেও ওই চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে, দিনটিকে ঘিরে দলের সব স্তরে নেতা-কর্মীদের বাড়তি সতর্ক থাকার নির্দেশনাই আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রস্তুতি। এছাড়া জেলা উপজেলায় সতর্ক থাকতে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় বলছে, যেহেতু ইস্যুটি আদালতের, তাই রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিকে মনোনিবেশ করছে না ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেন, খালেদা অপরাধী হলে শাস্তি হবে, নিরপরাধী হলে খালাস পাবেন। ফলে এখানে রাজনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই। আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে তারা ওইদিন কিছুই করবেন না। আইনিভাবেই মোকাবিলা করবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন প্রস্তুতি থাকবে? এই মামলা তো আওয়ামী লীগ করেনি। এছাড়া, এটি আদালতের বিষয়। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই।’
দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারক খান বলেন, ‘ইস্যুটি যদি রাজনৈতিক হতো, তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন হতো। বিএনপি সন্ত্রাসী কমর্কাণ্ড করলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে দেশে সরকার আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ে ভাবছে না আওয়ামী লীগ। রায়কে ঘিরে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করার চেষ্টা হলে তা মোকাবিলা করবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’
এদিকে ক্ষমতাসীন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মী সজাগ ও সতর্ক থাকবেন। তবে দিনটিকে নিয়ে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করে আওয়ামী লীগ নতুন সিদ্ধান্তও নিতে পারে বলে তারা জানান।