কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল সময়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ মনে করে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে সংস্থাটির স্বীকৃতি দানের তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে জানান হয়, আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে এমন বিষয়গুলোকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চেরও ভাষণও এই তালিকায় নথিভুক্ত করা হয়েছে।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান। এই পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। এই সমাবেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এমনকি স্বাধীনতার ডাক আসতে পারে বলেও প্রচার ছিল আগে থেকেই। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ হাজির হয় সমাবেশস্থলে।
বঙ্গবন্ধু তার ১৮ মিনিটের ভাষণে পাকিস্তানের ২৪ বছরে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য শোষণ তুলে ধরে বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তবে তিনি তার নির্দেশনা দেন অনেকটা পরোক্ষভাবে। ভাষণ তিনি শেষ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম বলে।’
আবার এই ভাষণের দেশের প্রতিটি জেলা, মহকুমা এমনকি গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেয়া হয়। সরকারকে খাজনা পরিশোধ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। এই ভাষণের পর থেকে সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলছিল। সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়।
আবার এই ভাষণের পর সেনাবাহিনীর একটি অংশও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরুর পরই শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।
ওই রাতে বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তবে ৭ মার্চই তিনি পরোক্ষভাবে এই ঘোষণা দেন বলে মনে করেন ইতিহাসবেত্তারা। এই ভাষণ বিশ্বের ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয় আর এই ভাষণের কারণে নিউজউইক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে উল্লেখ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে ভাষণটি দেয়া হলেও এখনও এর আবেদন কমেনি এতটুকু। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পরও জাতীয় দিবসগুলোতে দেশজুড়ে বাজানো হয় এই ভাষণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেই উচ্চারণ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা রাজনৈতিক ভাষণ। এবার ইউনেস্কোও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই কথাই জানাল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়, ৩০ অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর হেডকোয়ার্টারে ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা।
৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয় আরও আগে। ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি) গত ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে অন্যান্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি এই সিদ্ধান্তও নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৪২৭টিতে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, ‘ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে বিশ্ব এখন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারবে। একই সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে বিশ্ব সম্প্রদায়।’
মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।’