॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সূরা-কিরাত পাঠ করার পর হাঁটুতে হাত রেখে মস্তক অবনত করতে হয় অর্থাৎ রুকুতে যেতে হয়। রুকুতে তিনবার সুবহানা রাব্বিয়া আজীম তাসবীহ পড়তে হয়: অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময় বলতে হয়। সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ। এ সময়ে দু’হাতকে সোজাভাবে শরীরের দু’পাশে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এর পরেই আসে সিজদা। সিজদায় কপাল, নাক ও হাতের তালুকে মাটিতে রাখতে হয়। মনে মনে তিনবার বলতে হয় সুবহানা রাব্বিয়াল আলা। এরপর বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় কিছু সময় বসে আবার সিজদায় যেতে হয়। এবং তাসবীহ পাঠ করার পর আবার উঠে দাঁড়াতে হয়। একজন ব্যক্তির এই বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা, ইহরাম বাঁধা, সূরা-বিরাআত পড়া, নত হওয়া, পর পর দু’বার সিজদায় যাওয়া এসব কিছুর নাম হল রাকআত।
দ্বিতীয় রাকআতে প্রথম রাক’আতের মতো সূরা-কিরাত পড়তে হয়, রুকু-সিজদায় যেতে হয়, তাসবীহ বলতে হয়। শুধু পার্থক্য এই যে, দ্বিতীয় রাকআতে সে সেজাদা থেকে উঠে দাঁড়ায় না। বরং নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় বসে আত্তাহিয়াতু পাঠ করতে হয়।
সালাত আদায়ের জন্য যদি কিবলার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না যায়, তাহলে অনুমানে যে কোন দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা যাবে। আর আল্লাহ তো সর্বত্রই বিরাজমান। তবে সালাত আদায় করতে হবে খুবই ধীরস্থিরভাবে ও মনোযোগ সহকারে। দাঁড়ান অবস্থায় দৃষ্টি থাকতে হবে সিজদার সময় যেখানে কপাল ঠেকবে ঠিক সে স্থানে, আর রুকুর সময় দৃষ্টি থাকবে দু’পায়ের সম্মুখ ভাগে। ডান বাম অথবা উপরের দিকে তাকানো যাবে না। অনুরূপভাবে অহেতুকভাবে নড়াচড়া বা আগ-পিছ করা যাবে না। সর্বক্ষণ স্থির থাকতে হবে, রুকু-সিজদায় যেতে হবে নির্ধারিত ভঙ্গিমায়। দৈনন্দিন জীবনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজে আইন। পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি মানুষের জন্য এটা ফরজ। আর জানায়ায় সালাত ফরযে কিফায়া। সমাজের কিছু সংখ্যক লোক এ সালাত আদায় করলে অন্যদেরটা আদায় হয়ে যায়। আর কেউ যদি এ সালাত না পড়ে তাহলে সমাজের সবাইকে গুনাহগার হতে হয়।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অপেক্ষা জানাযার সালাত খানিকটা ভিন্নতর। জানাযায় সালাতেও ওযু করতে হয। কিবলামুখী হতে হয়, নিয়ত করতে হয়, সূরা-কিরাত পড়তে হয়। কিন্তু এখানে রুকু-সিজদায় যেতে হয় না, বা তাশাহুদের ভঙ্গিমায় বসতে হয় না। সালাত আদায় করতে হয় চার তকবীরে। প্রথমে আল্লাহু আকবর বলার পর সানা, সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোন একটি সূরা তেলাওয়াত করতে হয়। দ্বিতীয় তকবীরের পর নবী করীম (সা)-র উপরে দরূদ পাঠ ও সমস্ত মু’মিন মুসলমানের জন্য মোনাজাত করা হয়। তৃতীয় তকবীরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়। চতুর্থ তকবীরের পর সালাম ফিরিযে জানাযার সালাত শেষ করতে হয়। কেউ অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে এবং দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে সমর্থ না হলে সে তার সুবিধা অনুসারে বসে বা শুয়ে সালাত আদায় করবে। শুয়ে সালাত আদায় করার সময় সে নিয়ম মাফিক সূরা-ক্বিরাত ও দোয়া দরূদ পাঠ করবে। আর কল্পনায় রুকু-সিজদায় যাবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে। অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী অবস্থায় একজন মুসলমান বসে এমনকি শুয়েও নামায আদায় করতে পারে। বসে নামাজ পড়ার সময় সে এমনভাবে রুকুতে যাবে যাতে কপাল পানি স্পর্শ না করে। যদি শুয়ে শুয়ে নামাজ পড়তেই হয়, তাহলে সে পর্যায়ক্রমে দাঁড়ান, রুকু, সিজাদ ও তাশাহুদের কথা স্মরণ করবে। আর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমস্ত দোয়া-দরূদ তেলাওয়াত করতে হয়, মনে মনে সেগুলি তেলায়াত করতে হবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে।
কেউ যখন সফরে থাকে তখন সে চার রাক’আতের পরিবর্তে দুই রাক’আত ফরজ পড়ে থাকে। আবার বিশেষ পরিস্থিতে সময়ের স্বল্পতা বা প্রচন্ড চাপের মুখে থাকলে দু’ওয়াক্তের সালাতকে একত্রে আদায় করতে পারে। যেমন দুপুর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় যোহর ও আছর এর মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করা যায়। হজ্বের সময় আরাফাতে ও মুজদালিফায় এ ভাবে সালাত আদায় করতে হয়।
মাযহাব : ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্নতা ক্ষেত্রে মুসলমাদের মধ্যে প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় রয়েছে-সুন্নী, শিয়া ও খারিজী। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আবার বিভিন্ন দল বা মাযহাব রয়েছে। যেমন সুন্নীদের মধ্যে রয়েছে চারটি মাযহাব ঃ হানাফী, শাফী, মালেকী ও হাম্বলী। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা মাযহাবের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ বা আচরণ ও অনুষ্ঠানগত বৈষম্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখা যথেষ্ট যে নেতৃস্থানীয় ফকীহ ও মুজতাহিদগণ তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী করীম (সা.) এর বাণী ও আচার-আচরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। আমল করেছেন তদনুসারে। এখান থেকেই ফকীহগণের মধ্যে এক একটি মতের সূত্র পাত ঘটে। ধর্ম বিশারদগণের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে উঠে এক একটি মযহাব। বস্তুতপক্ষে কোন সম্প্রদায় বা মাযহাবেই নতুন কোন ধর্মবিশ্বাস বা আচারণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেনি। সকল সম্প্রদায়ের বা মাযহাবের ভিত্তিমূলে রয়েছে হাদীস।
কখনো কখনো নবী করীম (সা.) নিজেই বিশেষ কোন কাজ বা কাজের ধারাকে পাল্টে ফেলতেন। কখনো এ পরিবর্তন সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেন। যেমন-গোড়ার দিকে সালাতে রুকু করার সময় তিনি দুটি হাত নিচের দিকে সোজা ঝুলিয়ে রাখতেন। কিন্তু পরবর্তীতে হাত দুটি হাঁটুর উপর রাখতে শুরু করেন। এবং হাত ঝুলিয়ে রাখার বিধান বাতিল বলে ঘোষণা দেন। কখনো আবার এ জাতীয় পরিবর্তন সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতেন। নবী করীম (সা.) এর কোন কোন আমল বা কাজের সম্মতি সম্পর্কে আলোচনা উত্থাপিত হয় নবীজীর ওফাতের কয়েক পুরুষ পরে। তখন ধর্ম-বিশারদগণের মধ্যে দেখা দেয় মতপার্থক্য। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় দল-উপদলের। অর্থাৎ সুন্নতের বিভিন্নতার সূত্র ধরেই ফকীহগণের মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর সে কারণেই কোন সম্প্রদায়ের জন্য অন্য সম্প্রদায়ের মতবাদকে উপেক্ষা করার অধিকার নেই। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে কোন একটি কাজ নবী করীম (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করলেও কখন কিভাবে পরিবর্তন করেছেন, সবক্ষেত্রে তার ধারাবাহিক কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। যদি থাকত তা হলে স্বাভাবিক নিয়মেই পরের নিয়ম দিয়ে পূর্বের নিয়ম বাতিল হয়ে যেত। ফলে নবী করীম (সা.) একবার যে নিয়মটি পালন করেছেন, যেটার ব্যাপারে তিনি কখনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন নি, সেটাও একটা সুন্নত। আর এ সবকিছু মিলেই গড়ে উঠেছে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য নিয়ম-কানুন।
নবী করীম (সা.) এর যতগুলো উপাধি আছে তার মধ্যে একটি হল হাবীবুল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু। কুরআন মজীদে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে অনুকরণীয় সর্বোত্তম আদর্শ (৩১ ঃ ২১)। এ আয়াতের ব্যাখায় বলা যেতে পারে, আল্লাহ তা’আলা আশা করেন যে, মুসলমানরা প্রিয় নবী (সা.) এর সমস্ত আচার-আচরণের উপর আমল করবে। এমনকি তিনি অনিয়মিতভাবে যে কাজ করেছেন, অর্থাৎ শুরুতে যা করেছেন কিন্তু পরে করেননি, অথবা শুরুতে করেননি, কিন্তু পরে করেছেন তার কোনটাই বাদ যাবে না। এভাবেই মুসলমানরা একই কাজ বিভিন্ন ভাবে সম্পন্ন করবে, কিন্তু তাদের কোনটাই সুন্নতের বাইরে যাবে না। আল্লাহ তা’আলা যে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা মাযহাব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নবী করীম (সা.)-এর সমস্ত কাজকে একটি স্থায়ী রূপ দিয়েছেন। আর সে কারণেই সমস্ত মাযহাবে মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। কেউ কারো প্রতি অসুহিষ্ণু হতে পরে না।
সালাতের আরবির ব্যবহার : এটা জানা কথা যে, মুসলমানরা আরবি ভাষায় সালাত আদায় করে থাকে। তাদের দোয়া-দরুদ পাঠ, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল সব কিছুর ভাষা রীতি আরবি। আরব-অনারব, এমনকি যে সমস্ত এলাকার মুসলমান আরবি জানে না বা বোঝে না, তাদেরও সালাতের ভাষা আরবি। নবী করীম (সা.) এর আমলে এ নিয়মটি চালু ছিল। চৌদ্দ শ’ বছর পর এখনও এ নিয়ম অব্যাহত রয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে হবে যে, একজন লোক যে ভাষা বোঝে, সে ভাষাতেই আল্লাহ তা’আলার দরবারে আবেদন-নিবেদন জানাবে। আর এটা জানা কথা যে, মাতৃভাষাই হল ইবাদত-বন্দেগী করবার ও তাসবীহর উত্তম মাধ্যম। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, একজন মুসলমান যে ভাষায় কথা বলে সেটাই হবে তার সালাতের ভাষা। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সাধারণ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করলে এ ধরনের যুক্তির অসারতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রথমেই আসে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। কুরআনুল করীমের বর্ণনা অনুসারে, নবী করীম (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীগণকে বলা হয় উম্মুল মু’মিনীন। অর্থাৎ মু’মিনদের মাতা। তাঁদের সবারই মুখের ভাষা ছিল আরবি। সে বিবেচনায় সকল মুসলমানের মাতৃভাষাও আরবি। সুতরাং মাতৃভাষায় দোয়া-দরূদ তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করতে আপত্তি উঠবে কেন? কারো কারো জন্য এ যুক্তি পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। তাদের জনা আবশ্যক যে, ইসলামী আকীদা অনুসারে কুরআন হল আল্লাহর কালাম। কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত অনেক। নফল ইবাদতের মধ্যে এটা সর্বোত্তম ইবাদত। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে একজন মুসলমান মূলত আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যে পৌছে এবং এটাই একজন মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য। এটা যেন আল্লাহর দরবারে পৌছার একটি পথ। বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দিয়ে বাল্বে যেভাবে আলো সঞ্চারিত হয় এও যেন ঠিক তাই। যারা অধিকতর বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন তাদের জন্য বলা আবশ্যক যে, দোয়া হল আল্লাহ তা’আলার দরবারে আবেদন-নিবেদন করার একটা মাধ্যম। এটা একজনের একান্ত নিজস্ব ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে কোন ভাষায় বা ভঙ্গিমায় আল্লাহর কাছে নিবেদন করা যায়। এমনকি দোয়া বা মোনাজাতে ব্যক্তি যা ইচ্ছা তাই চাইতে পারে। এ ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে বান্দা এককভাবে স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। আর সালাতের বিষয়টি এর ঠিক উল্টো। এখানে আল্লাহ তা’আলার হক আদায় করার ব্যাপারটা মুখ্য। এটা আদায় করতে হয় সম্মিলিতভাবে, জামাআত সহকারে। ফলে সালাতে কেউ নিজস্ব পছন্দ অনুসারে চলতে পারে না। সালাতের নিজস্ব একটি ভঙ্গিমা ও পদ্ধতি রয়েছে। রয়েছে আরকান-আহকাম। জামাআতে ফরয আদায় করা একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে অধিক সাওয়াবের। যদি ইসলাম বিশেষ কোন অঞ্চল, গোত্র বা জাতির জন্য নির্ধারিত হত, তাহলে মুসলমানরা অবশ্যই আঞ্চলিক, জাতীয় বা গোত্রীয় ভাষায় ধর্ম চর্চা করতে পারত। কিন্তু ইসলাম একটি সার্বজনীন ও চিরন্তন ধর্ম। ইসলামের আবেদন বিশেষ কোন অঞ্চল গোত্র বা কালের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। বরং মুসলমানরা অংসখ্য ভাষায় কথা বলে। তারা বসবাস করে বিভিন্ন গোত্র ও অঞ্চলে। বর্তমান সময়ে আমাদের জীবন অধিকতর বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সবগুলো শহরেই মুসলমানদের সাক্ষাৎ মেলে। তারা সে সমস্ত শহরের স্থায়ী অধিবাসী অথবা সফরকারী যেভাবেই থাক না কেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে। ধরে নেই যে, একজন ইংরেজ চীনদেশ সফরে গেল। চীনা ভাষার একটি অক্ষরও সে বুঝে না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ করেই সে শুনতে পেল ‘চিং চ্যাং চাং’-স্বাভাবিকভাবেই সে এর অর্থ বুঝেবে না। এর কারণও জানতে পারবে না। আর এটা যদি ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দের আঞ্চলিক পরিভাষা হয় তাহলে হয়ত সে শুক্রবারের জুম্মার নামাজ থেকে বঞ্চিত হবে। অথবা বঞ্চিত হবে অন্য কোন ওয়াক্তের সালাত থেকে।
বলে রাখা আবশ্যক যে, চীন দেশের মসজিদগুলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা প্রাচ্যের মসজিদগুলোর মতো নয়, এমন কি এখানকার মসজিদগুলোর কোন মীনার নেই। ফলে মসজিদ দেখেও সালাতে হাজির হওয়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে একজন চীনদেশীয় মুসলমান যদি অন্য কোন দেশে যায়, এবং সে দেশের মুসলমানরা যদি আঞ্চলিক ভাষায় ইবাদত-বন্দেগী করে, তাহলে সেও জামাআত থেকে বঞ্চিত হবে। নিজে মুসলমান হয়েও সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে কোন মিল খুঁজে পাবে না। আর সে কারণেই ধর্ম চিরন্তন, যার আবেদন স্থান, কালভেদে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে, তার এমন কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকবে যা সকল অনুসারীদের মধ্যে স্পষ্টভাবে বিরাজমান। বস্তুত সালাতের জন্য অভিন্ন আযান ধ্বনি এবং সালাতের নিয়ম-কানুনগুলো এমনি বৈশিষ্ট্যে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, কখনো কখনো দু’টি ভাষার মধ্যে এমনি কিছু শব্দ থাকে যেগুলো শ্রবণের দিক থাকে একই ধরনের। কিন্তু তাদের আন্তর্নিহিত অর্থ সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। কখনো কখনো আবার একটি ভাষার একটি সাধারণ শব্দ অন্য ভাষায় খুবই জঘন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। যে ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি যত কম, সে ভাষার ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আর আল্লাহ তা’আলার ইবাদ-বন্দেগীর ক্ষেত্রে যদি এমন কিছু শব্দ চলে আসে তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক এবং আদবের মস্তবড় বড়খেলাফ। কিন্তু কেউ যদি বাল্যবয়স থেকেই একটি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে, তাহলে অনায়াসেই এ জাতীয় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিকে পরিহার করা যায়। সে ক্ষেত্রে একজন অনারবও যদি আরবি ভাষায় দোয়া-দরূদ তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করে তাতেও কোন সমস্যা হতে পারে না। কখনো কখনো এমন সব পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, যখন একজন ব্যক্তি কোন ভাষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে। তখন ইংরেজ হয়ত ফরাসী, রাশিয়ান বা অন্যকোন ভাষায় সালাত আদায় করতে অস্বীকার করবে। রাজনৈতিক এমনকি ব্যক্তিগত কারণেও কারো মধ্যে এ রকম অনাগ্রহ জন্মাতে পারে। কিন্তু আরবি কুরআন হাদীসের ভাষা। ফলে যে কোন মুসলমানেরই এ ভাষার প্রতি রয়েছে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও একটি স্বভাবজাত আকর্ষণ। এমতাবস্থায় আরবিভাষী কারো প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হলেও কুরআনোর ভাষার প্রতি সবাই থাকে আন্তরিক।
বস্তুতপক্ষে আরব জাতির ভাষা হিসাবে আরবির কোন গুরুত্ব নেই। বরং গুরুত্ব এ কারণে যে, নবী করীম (সা.) এ ভাষায় কথা বলতেন, উম্মুল মু’মিনীনের মুখের ভাষা আরবি। সর্বোপরি আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র কালামকে মানুষের নিকট পৌছে দেওয়ার মাধ্যম হিসাবে আরবি ভাষাকে নির্বাচন করেছেন। সমধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিকে জোরদার করার জন্য নতুন পন্থা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে ঐক্য বজায় রাখার জন্য বর্তমানে যে ব্যবস্থা বা উপকরণ চালু রয়েছে তাকে উপেক্ষা করার প্রশ্নটি একান্তই অযৌক্তিক। ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও ইবাদত-বন্দেগীতে একটি সাধারণ ভাষা ব্যবহারে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উদাহরণ হিসাবে আন্তর্জাতিক সভা সম্মেলনের কথা বলা যেতে পারে। জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে কেউ তার খেয়ালখুশি ও ইচ্ছামত যে কোন বক্তব্য রাখতে পারে না। যদি কেউ এমনটি করেও থাকে, তাহলে তার বক্তব্য দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। সভার মূল উদ্দেশ্যই তাতে পন্ড হয়ে যাবে। আর সে কারণেই তার বক্তব্যকে অবশ্যই সম্মেলন কর্তৃক স্বীকৃত কোনো ভাষার অনুবাদ করার সুযোগ দিতে হয়। এ ব্যাপারে কেউ কোন রকম আপত্তি তুলতে পারে না। অর্থাৎ তার মাতৃভাষা যাই থাক না কেন, তাকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য বিশেষ কোন ভাষার উপর নির্ভর করতে হয়। আরো বলা যেতে পারে কোন অনুবাদই কখনো মূল রচনার সমতুল্য হতে পারে না। তাই দেখা যায় যে, ইতিমধ্যে কুরআনুল করীমের বেশ কিছু ইংরেজি তরজমা প্রকাশিত হলেও এখনো অনেকে নতুনভাবে তরজমা করার উদ্যোগে নিচ্ছেন। নতুনভাবে তরজমা করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় সবাই বলেন অতীতের তরজমাগুলোর চাইতে বর্তমান তরজমাটি ভালো, আরো সাবলীল। অনুবাদের জন্য নতুন উদ্যাগ গ্রহণ করতে হচ্ছে এ উদ্যোগে কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। শুধুমাত্র কুরআনুল করীমে ইংরেজি তরজমার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোন গ্রন্থের যে কোন ভাষার তরজমার ক্ষেত্রেই একথা সত্য। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে মূল ভাষা আরবিকে বাদ দিয়ে ত্র“টিপূর্ণ তরজমা দিয়ে সালাত আদায় করা কি ঠিক হবে? প্রশ্ন উঠতে পারে যে, অন্যান্য ধর্মে বিভিন্ন ভাষায় ইবাদত-বন্দেগীর সুযোগ থাকলে ইসলাম ধর্মে থাকবে না কেন? এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে যে দুনিয়ার কোন ধর্মগ্রন্থই এখন আর মূল ভাষায় অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থ নাযিল হয়েছিল সে ভাষায় পাওয়া যায় না। আবার কিছু গ্রন্থ আছে যার অনুবাদ মূলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তো নয়ই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কজাত চিন্তা থেকে সংযোজিত। এগুলো হয় অনূদিত অবস্থায় অথবা মূল গ্রন্থের অংশ বিশেষরূপে আমাদের হাতে পৌছেছে। ইয়াহূদী, খৃষ্টান এবং অন্য যে কোন ধর্মের জন্য একথা সত্য। এর ব্যতিক্রম ঘটছে একমাত্র কুরআনুল করীমের ক্ষেত্রে। কুরআনুল করীম যে ভাষায় এবং যতটুকু অবতীর্ণ হয়েছিল, এখনো তা মূল ভাষায় এবং অপরিবর্তিত রয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইসলামীক কায়দায় দৈনন্দিন জীবনের পরিকল্পনা এবং গন্ডিরেখার পথে চলার তাওফিক দান করুন-আমীন। (সমাপ্ত)