‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত আরাফার ময়দান

80

কাজিরবাজার ডেস্ক :
খোদার ঘরের মেহমানরা আরাফার ময়দানে হাজির হয়ে প্রাণভরে উচ্চারিত করছেন ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা 1504205400_68লাব্বাইক/লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক/ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক’। অর্থ হচ্ছে, ‘হে আল্লাহ আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধুই তোমার। সব সাম্রাজ্য তো তোমারই।’
একই সঙ্গে খোদার ঘরের মেহমানরা আরাফার প্রান্তরে অনুভব করছেন রাব্বুল আলামিনের সেই মায়াভরা বাণী। যেখানে মধুর সুরে আল্লাহ বলছেন- ‘নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওয়ারিদ। (কাফ, আয়াত-১৬)। অর্থ- হে আমার প্রিয় বান্দা, আমি তোমার শাহরগের কাছে থাকি।
তাই তো গতকাল দিনভর আরাফার ময়দানে রাব্বুল আলামিনের অনুভব, অনুভূতির শিহরণ হবে প্রেমিক মনে। জীবনের আপদমস্তক গোনার দৃশ্য স্মরণ করে হৃদয়ভাঙা আহাজারি করবেন হাজিরা- ক্ষমা করুন, করুণা ধারা বর্ষণ করুন, হে রাব্বুল আলামিন দৃশ্য অদৃশ্য জগতের মালিক। হৃদয় ফাটা আর্তনাদে মরুর বুক ভেসে যাবে কান্নায়। লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক- আমি হাজির, আমি হাজির বেজে উঠবে। আত্মা আর পরমাত্মার সুরে সিজদাবনত হবে আরাফাবাসী।
হাজীরা আজ মাওলার প্রেমে মজে থেকে রাব্বুল আলামিনের অকূল সাগর পাড়ি দেবেন প্রেম তরীতে। কাফনের সাদা দু’টুকরা ইহরামের কাপড় পরে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল তারা। আশেক আর মাশুকের প্রেমময় আবহে বিরাজ করবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্য।
ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করার পরপরই হাজীরা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছুটেন আরাফার ময়দানে। লাব্বাইক, লাব্বাইক সুর ধ্বনি তুলে রাব্বুল আলামিনের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেন তারা। ক্ষমা ও মুক্তির জন্য হাজীরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে রোনাজারি করবেন। কেউ পাহাড়ের কাছে, গাছের নিচে, তাঁবুর ভেতর, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ধ্যান ইবাদত করবেন।
এই আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়েই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। লাখো মানুষের উদ্দেশে প্রদত্ত এ ভাষণের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল দ্বীনের পরিপূর্ণতার। আজো সেই ধারাবাহিকতায় খুতবা-ভাষণ দেয়া হয়। ভাষণে গোটা বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। আর হাজীরা এক আবেগঘন পরিবেশে মহান আল্লাহর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়ার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে আহাজারি করতে থাকেন। তারা নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুখ শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
৯ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পরপরই মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন হাজীরা। মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ, এশার ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সারা রাত সেখানে অবস্থান করবেন তারা। মিনায় জামারাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭টি কঙ্কর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশে রওনা হবেন। পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ৯ মাইল পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ের নাম ‘জাবালে রহমত বা করুণার পাহাড়’।
এ পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রলম্বিত বিরাট প্রান্তরটি আরাফা প্রান্তর নামে পরিচিত। এর উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। এ পাহাড়ের পূর্বদিকে পাথরের সিঁড়ি রয়েছে। এর ষষ্ঠ ধাপের উচ্চতা বরাবর আগে একটি উন্নত মঞ্চ ও একটি মিম্বর ছিল। এ মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রতি বছর ৯ জিলহজ্ব আরাফার দিন ইমাম খুতবা প্রদান করতেন। এখন আর সেই মঞ্চ ও মিম্বার নেই এবং এখান থেকে হজ্বের খুতবাও প্রদান করা হয় না। বরং এখন খুতবা দেয়া হয় মসজিদে নামিরা থেকে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর মাত্র ১ দিন হাজীরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন। হজ্বের সময় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজ্বের অন্যতম ফরজ বিধান। ইমাম তিরমিযী (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আরাফার ময়দানে অবস্থান করার ভাগ্য যার হয়নি তার হজ বাতিল হয়ে যাবে।
হজ্ব অর্থ সংকল্প করা, দর্শন করা। রাব্বুল আলামিনের প্রেমের অনন্য নিদর্শন এই হজ। কাবা শরিফের তাওয়াফ, মদিনা শরিফের জিয়ারত, মুজদালিফা, মুলতাজাম, হাজরে আসওয়াদ, জমজম, মাকামে ইবরাহিমের সায়ী, উকুফে আরাফা, জামারাত কোরবানি, বিদায়ী তওয়াফ’ এগুলো মুমিনের জন্য রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যস্থল। মুমিনের হৃদয়ে যখন রাব্বুল আলামিনের ইশক ও মুহাব্বতের বর্ষণ শুরু হয় তখন থেকে হজের জন্য কাতর হতে থাকে তার আত্মা বা রূহ।
হজ্ব মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর চেতনা ও আদর্শের প্রতীক। হজ্বের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে আল্লাহর একত্ববাদ, একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সমৃদ্ধ স্বীকৃতি। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনজুড়ে ছিল কঠিন সব পরীক্ষা। সেসব পরীক্ষা ছিল দুনিয়ার বিচারে অবাস্তব অকল্পনীয়, বিবেকের কাছে যা অগ্রহণীয়।
সব পরীক্ষাই তাকে দিতে হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো- যেখানে কোনো গাছপালা, ফল-শস্য, পানি বা লোকজনের বসতি নেই স্ত্রী সন্তান সেখানে রেখে আসার। এমন পরীক্ষাতেও হজরত ইবরাহিম (আ.) উত্তীর্ণ হলেন। উপাধি পেলেন খলিলুল্লাহ- আল্লাহর বন্ধু নামের প্রেমময় ভূষণ। সেই জনমানবহীন ভূমিই আজ বিশ্ব মুসলিমের তীর্থস্থান। সেখানেই সমাধা করতে হয় হজের যাবতীয় ব্রত। পরের পরীক্ষা আরও কঠিন। পিতা পুত্রকে জবাই করতে হবে, এটা আল্লাহর আদেশ।
এ কাজেও হযরত ইবরাহিম (আ.) স্বতঃস্ফূর্ত রাজি হয়ে গেলেন। আল্লাহ প্রেমিক কাকে বলে! প্রেমের দৃষ্টান্ত রাখলেন পিতা-পুত্র। পুত্রও পিতার হাতে জবাই হতে রাজি হয়ে গেলেন। কোরআনের ভাষায়, হে পিতা আপনি বাস্তবায়ন করুন যা আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ইনশাল্লাহ আপনি আমাকে পাবেন ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা সাফফাত ১০২)। আল্লাহ ডেকে বললেন- হে ইবরাহিম তুমি বাস্তবায়ন করেছ তোমার স্বপ্নাদেশ। (তুমি সফল ও সার্থক হয়েছে)। মাওলার প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। ওই প্রেম ও ভালোবাসার আলোকচ্ছটায় যার আত্মা উদ্ভাসিত হয় সেই তো কাবার প্রেমে ব্যাকুল হয়ে কালো গিলাফ দর্শনে আকুল হয়ে হজ্বব্রতে ছুটে আসেন।
হজ্বের অন্যতম বিশেষ ইবাদত হল আল্লাহর জন্য পশু কোরবানি করা। আল্লাহ বলেন, কোরবানির পশুর গোশত কিংবা রক্ত কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না, পৌঁছবে শুধু তোমাদের কলবের তাকওয়া (সূরা হজ্ব, আয়াত ৩৭)। এটিই কোরবানির শিক্ষা। হযরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.) যখন আল্লাহর আদেশের সামনে কোরবান হয়ে গেলেন এবং পিতা ইবরাহিম পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর গলায় ধারালো ছুরি চালালেন তখনই আল্লাহ বললেন ‘(থামো) হে ইবরাহিম! স্বপ্নকে তো তুমি সত্য করে দেখালে। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০৫) এবং কোরবানি করার জন্য আল্লাহ জান্নাত থেকে দুম্বা পাঠালেন। আর বললেন, ‘এভাবেই আমি মুহসিনিনদের পুরস্কৃত করি’ (সূরা আল-সাফফাত, আয়াত ১০৫)।