জেরজিজ ফাতেমা রেখা
আইনের মানুষ না হয়ে আইন বিষয়ে কিছু লেখা খুব সহজ নয়। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজে পড়ে জেনে লেখা যে অসম্ভব তাও নয়। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আলোচনাটা এখন মোটেই আর আইনগত জায়গায় নেই। জাতি, ব্যক্তি, ঘৃণা বিদ্বেষের জায়গায় চলে গেছে আর এই জায়গাটায় নিয়ে গেছেন রাজনীতিবিদরা। রায়ে যা লেখা নেই, অভিযোগে তা সামনে আনা হচ্ছে। আবার সম্পূর্ণ অসত্য বক্তব্য বারবার সামনে আনা হচ্ছে। যা এই রায়ের সঙ্গে একেবারেই সংশ্লিষ্ট নয়। বিষয়গুলো নিয়ে খুব সহজ সরলভাবে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
এই রায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, কিন্তু বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে বারবার। সামনে আনছেন সাবেক বিচারপতি শাসমসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি নিজে বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। সুতরাং তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছেন। যদিও কোথাও এর কোনও তথ্য প্রমাণ নেই বা পাওয়াও যায়নি। মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের মামলার প্রসঙ্গ এসেছিল যে, কেন কিছু সংখ্যক মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করা হচ্ছে, কেন সব অপরাধীর রাজাকারদের বিচার করা হবে না। এমন প্রসঙ্গের প্রেক্ষিতে বিচারকের আসনে বসে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন “ ধরেন”, আমি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম। কিন্তু জ্বালাও পোড়াও, খুন ধর্ষণ করিনি। এখন এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ আর এই অপরাধ কি এক হবে? এই বক্তব্যটির ‘ধরেন’, শব্দটি বাদ দিয়ে মাননীয় সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এই কথাটির ভিন্ন রূপ দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এবং এই সাবেক বিচারপতি বর্তমান বিচারপতি কে ‘সিনহা বাবু’ হিসেবে উল্লেখ করে টকশোতে কথা বলেন। একজন প্রধান বিচারপতির প্রতি একজন সাবেক বিচারপতির এই সম্বোধন এবং বিকৃত করে বক্তব্য উপস্থাপন বিষয়ে মন্তব্য করলে প্রশ্ন আসে দুইটা (১) সাবেক বিচারপতির কি কোন কারণে কোন ক্ষোভ আছে বর্তমান বিচারপতির উপর? (২) নাকি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে এই সম্বোধন?
এবার আসি ষোড়শ সংশোধনীর রায় পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে। আসলে রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে নয়, যে অংশ বা বক্তব্য বা অভিযোগগুলো সামনে আনা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে। মোটা দাগে যে অভিযোগগুলো আমাদের সামনে সেগুলো হচ্ছে- (ক) বঙ্গবন্ধুকে হেয় বা কটাক্ষ করা হয়েছে। (খ) রায়ে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ লিখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করা হয়েছে। (গ) সংসদ সদস্যদেরকে হেয় বা অসম্মান করা হয়েছে।
এই উপরোক্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে যা লেখা হয়েছে সেটা দেখা যাক। এখানে বলে রাখা দরকার যে, রায় পর্যবেক্ষণের কোথায়, কোন অংশে, কোন বাক্য বা শব্দ দিয়ে ‘কটাক্ষ’ বা ‘অম্মানে’র ঘটনা ঘটেছে, তা সুনির্দিষ্ট করে এখনও পর্যন্ত কেউই বলেননি। পুরো রায়ের কোথাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি, কটাক্ষ তো বহুদূরের বিষয় বাঙ্গালীর জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং তা ‘আমরা’ তত্ত্বে ‘আমি’ তত্ত্বে নয়। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধ তাও ‘আমরা’ তত্ত্বেরই প্রমাণ বহন করে। তা পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট ভাবেই লেখা হয়েছে। স্পষ্ট করেই লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুই জাতির জনক।
‘জাতির জনক’ একজন এবং তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাহলে রায়ে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ লেখা হল কেন? এর মাধ্যমে জাতির জনক হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে নয় অনেককেই বোঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সাবেক বিচারপতি। গত ২১ আগষ্ট একাত্তর টেলিভিশনের টকশো ‘একাত্তর জার্নালে’ সঞ্চালক মিথিলা ফারজানা ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং উপস্থিত অতিথিরা আলোচনা করেন। তবে অতিথিরা পরিষ্কার করে জবাব দিতে পারেননি। তবে রায়টি পড়ে সাধারণভাবে যা বুঝলাম তা হলো- ক) রায় পর্যবেক্ষণে ‘ফাদার অব দ্যা নেশন’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের ৩০, ৫৪ ও ২০০ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে লেখা হয়েছে। পুরো রায়ে আরও কোথাও থাকতে পারে হয়ত আমার চোখে পড়েনি। খ) এর পর আসছে ফাউন্ডিং ফাদারস কেন লেখা হল এস’ কেন যোগ করা হয়েছে? যারা মুক্তিযুদ্ধ সূচনা করেছিলেন, সম্মিলিতভাবে তাদেরকে ‘ফাউন্ডার্স এবং ফাউন্ডিং ফাদার্স’ হিসেবে বোঝানো হয়েছে। এই দু’টি শব্দ দ্বারা ঐতিহাসিক সত্যি আইনগতভাবে স্বীকৃতি বা ভিত্তি পেয়েছে। ‘ফাদার্স এর এস’ দিয়ে যে বঙ্গবন্ধু যে ‘জাতির জনক’ তা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, এটা শতভাগ অপব্যাখ্যা।
এবার আমি সংসদ সদস্যদের অসম্মান করা প্রসঙ্গে। অভিযোগ করা হচ্ছে রায়ে সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ক বলা হয়েছে। বাস্তবে সংসদ সদস্যদের নয়, বাংলাদেশের সাংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘ডিসফাংশনাল’ বলা হয়েছে বা ‘অকার্যকর’ বলা হয়েছে। তা কি অসত্য? সংসদ সদস্যদের ষোড়শ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর সংসদে এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বাইরের আলোচনা কি রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রমাণে যথেষ্ট নয়।
আরও মজার বিষয় রায়-পর্যবেক্ষনের কোথাও ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতার নির্বাচন গঠিত সংসদের কথা সুনিদ্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অথচ বর্তমান সংসদ সদস্যরা মনে করে নিয়েছেন তাদের কথা বলা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকান্ড তথা ক্রিমিনাল আফন্সের প্রসঙ্গ জোরালো ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে। মজার বিষয় হলো এটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না। প্রধান বিচারপতিসহ ৭জন বিচারপতিকে সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানানোর কথা! তা না করে রায়ে যা লেখা হয়নি তার জন্য তারা নিষোদগার করছেন। রায় পর্যবেক্ষণে ৪৬ বছরের বাংলাদেশের একটি ছবি আঁকা হয়েছে। এই ছবি কারও পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই ছবি পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। ‘নির্বাচন’ ব্যবস্থা ঠিক নেই, সব প্রতিষ্ঠান দিনদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সংসদ অকার্যকর- এসবই এসেছে ষোড়শ সংশোধনীর রায়-পর্যবেক্ষণে আঁকা ছবিতে। এই ছবির আঁকা কোন অংশ কি অসত্য? উত্তরে বলা হচ্ছে ‘না’ ঠিক আছে, অসত্য নয়। বিচারকরা রায়- পর্যবেক্ষণ লিখবেন আর বাইরে থেকে ঠিক করে দেওয়া হবে। প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয় ? তাহলে কি এই বিচার ব্যবস্থা চাইছি আমরা।
সামরিক শাসনসহ অসংখ্য বিষয় যে রায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে, তার প্রেক্ষাপট রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল তৈরী করেছিলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা সামরিক শাসকরা এনেছেন। এই যুক্তি দিয়ে সামরিক শাকদের সবকিছু বাদ দেওয়ার নীতির পক্ষে আবেগী যুক্তি আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। অ্যাটর্নি জেনারেল এর বক্তব্য ছিল খন্ডিত। বিচারপতিরা প্রতিটা বিষয় উল্লেখ করে দেখিয়েছেন। রায়- পর্যবেক্ষণে দেখানো হয়েছে। সামরিক শাসকদের সংযোজন ‘বিসমিল্লাহ’ ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দেওয়া হয়নি। সামরিক শাসকদের সবকিছু সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল এর এই উপস্থাপনা সঠিক নয়। বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে বিস্তারিত ইতিহাস প্রাসঙ্গিকভাবে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে এনছেন বিচারপতিরা।
আর এখন যা করা হচ্ছে তা বিবেচনা প্রসূত কিছু না। রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে যারা দেশ পরিচালনা করছেন তাদের তা অনুধাবন করা দরকার।