॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
কুরবানী মুসলিম মিল্লাতের ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় এক ইবাদত। এটি হজ্বের একটি অংশ। অবশ্য হজ্ব অনুষ্ঠান ছাড়াও গোটা বিশ্বের মুসলমানগণ ঈদুল আজহা শেষে কুরবানী করে থাকেন। শুধু কুরবানী নয় গোটা হজ্ব অনুষ্ঠানটিই ঐতিহাসিক চেতনাসমৃদ্ধ একটি ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহ্র নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভূক্ত।’’ (সূরা ২ বাকারা: ১৫৮) মনে রাখা প্রয়োজন কুরবানী ও হজ্বের ঐতিহাসিক চেতনাকে বিস্মৃত রেখে পালন করা হলে এ এক ব্যর্থ কসরত ছাড়া আর কিছু ফায়েদা বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এ জন্য হজ্বের প্রতিটি হুকুম পালন কালে অবশ্যই এর ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে নিয়ে পালন করতে হবে। এজন্য হজ্বের প্রতিটি হুকুম পালন কালে অবশ্যই এর ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে নিয়ে পালন করতে হবে। অন্যথায় হজ্ব অনুষ্ঠান স্রেফ একটি অনুষ্ঠানই থেকে যাবে। হজ্বের প্রায় সবক’টি অনুষ্ঠানের পিছনে মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর সহধর্মিনী বিবি হাজেরা সহ তাঁদের সংগ্রামমুখর জীবনের একান্ত সহযোগী তাঁরই সুযোগ্য পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এবং তাঁদের সম্মিলিত দু’আর ফসল শেষ নবী রাসূলে আকরাম (সা.) এর ত্যাগ ও কুরবানীর ইতিহাস বিজড়িত। যারা আল্লাহর মেহমান হয়ে আল্লাহর ঘরের কাছে যাবেন তাঁরা হৃদয়ের কান পেতে শুনবেন, সেখানকার আকাশ-বাতাসে নাস্তিক ও শিরকের মুলোৎপাটনকারী এ দু’জন সংগ্রামী মানুষের দোয়া এখনো গুঞ্জরিত হচ্ছে। মক্কা ও মদীনার অলি-গলি, মাঠ-ঘাট ও ধূ-ধূ মরুভূমির পরতে পরতে এবং হজ্বের সমগ্র পরিবেশে রাসূল (সা.) এর সংগ্রামমুখর জীবনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মনের চক্ষু দিয়ে দেখবেন মক্কা, মদীনা ও তায়েফের রাস্তায় এখনো মানবতার দরদী নবী (সা.) ও হযরত বেলালের লাল রক্তের কাঁচা দাগ যেন এখনো শুকায়নি। রাতের আঁধারে অনুভব করবেন, ঐ বুঝি মহাকালের সফল রাষ্ট্রনায়ক, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ওমরে ফারুক (রা.) ক্ষুধার্ত দু:খী মানুষের খোঁজে বেরিয়েছেন অথবা ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেয়ার নিমিত্তে বস্তা পিঠে পথ চলছেন। উহুদের প্রান্তরকে এখনো কাঁপিয়ে তুলে হক-বাতিলের দ্বন্দ্বে শাহাদাত বরণকারী রাসূলের অতি প্রিয়জন ও সম্মানিত চাচাজান বীর সেনানী আমির হামজা (রা.)। জান্নাতুল বাকিতে দেখবেন নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদে শত শত সাহাবায়ে কেরামের শাহাদাতের নযরানার উজ্ব¡ল নির্দশন আজো জ্বল জ্বল করছে। মিনায় কুরবানীর প্রাক্কালে চোখের সামনে নিয়ে আসবেন নাস্তিক ও শিরকের মূলোৎপটানকারী পিতা ও পুত্র তথা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগ ও আল্লাহর আনুগত্যের বাস্তব নমুনার ইতিহাস।
এ প্রবন্ধে শুধুমাত্র কুরবানীর আলোচনাই করতে চাই। কারণ এটি এমন এক চেতনার নাম যা আল্লাহর ঘরের মেহমান সম্মানিত হজ্ব যাত্রী সহ সকল মুসলমানের জন্য সমভাবে কাজে আসবে। সম্মানিত হজ্বযাত্রী ও কুরবানকারীদের অনুরোধ করব প্রবন্ধটি সামান্য সময়ের জন্য হলেও পড়ে নিবেন এবং নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদে ও ইসলামী আন্দোলনে নিজেদেরকে উদ্দীপ্ত করবেন। আমরা যে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে প্রতিবছর কুরবানী করি এটি মূলত একটি প্রতিকী কুরবানী। কিন্তু ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসলে আমরা দেখতে পাই এর আগে আরো কতগুলো কুরবানী রয়ে গেছে। ঐ কুরবানীগুলো না দেয়া পর্যন্ত এ শেষ কুরবানী দেয়ার অধিকার কারো নেই। অবশ্য কুরবানী আমরা দিয়ে যেতে পারবো ঠিকই এবং দিয়ে যাচ্ছিও বটে কিন্তু তা আমাদের জীবনকে কতটুকু প্রভাবান্বিত করতে পারছে তার বাস্তব ফলাফল তো আমাদের সামনেই আছে। কই কোথাও তো পরিবর্তনের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং কুরবানীর সার্থকতা তখনই পাওয়া যাবে যদি নিম্নের কুরবানীগুলো আগে দেয়া যায়। সেই কুরবানীগুলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনাদের সামনে পেশ করা হলো:
প্রথম কুরবানী ঃ প্রথমত সকল প্রকার মিথ্যা প্রভু তথা তাগুত, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি বিভাগে প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্নভাবে প্রভু সেজে বসে আছে, তাদের আনুগত্যের গলায় ছুরি চালাতে হবে। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে এক ও লা-শরিক আল্লাহর কাছে নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে বা পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে। সকল প্রকার তাগুত থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর দিকে রুজু হতে হবে। হযরত ইবরাহিম (আ.) সে কাজটিই আগে করেছিলেন। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেটি ছিল পুরোহিত পরিবার, যে পরিবার নক্ষত্র পূজায় দেশবাসীর নেতৃত্ব দিতো। যে পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেন সে সমাজটি ছিল আপাদমস্তক নাস্তিক, শিরক ও মূর্তি পূজায় নিমজ্বিত। প্রথমত: তিনি নিজ জাতি ও পরিবারের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি দ্বিতীয়ত: পৈতৃক মন্দিরের পৌরহিত্যের মহাসম্মানিত গদিটি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল, যেখানে বসলে তিনি অনায়াসেই জাতির নেতা বনে যেতেন। চারদিক থেকে নযর-নিয়ায এসে জড় হত এবং জনগণ ভক্তি-শ্রদ্ধা ভরে মাথানত ও হাত জোড় করে বসত। সাধারণ মানুষ হতে বাদশাহ পর্যন্ত সকলকে আজ্ঞানুবর্তী গোলাম বানিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু এ বিরাট স্বার্থের উপর পদাঘাত করে সত্যের জন্য দুনিয়া জোড়া বিপদের গর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রভুর সন্ধানে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রকে বাতিল প্রভু ভেবে ভেবে অবশেষে যখন সত্যের আলোর সন্ধান পেলেন, তখন নিজ জাতি ও পরিবারকে উদাত্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন: ‘‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে কর তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই।’’ তিনি আরো বললেন: ‘‘আমি সবদিক হতে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য নির্দিষ্ট করলাম, যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নহি।’’ এ পূর্ণাঙ্গ মানুষটি যৌবনের শুরুতেই যখন আল্লাহকে চিনতে পারলেন তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে বললেন: ‘‘ইসলাম গ্রহণ কর- স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ কর, আমার দাসত্ব স্বীকার কর। তিনি উত্তরে পরিষ্কার ভাষায় বললেন: আমি ইসলাম কবুল করলাম, আমি সারাজাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করলাম, নিজেকে তাঁর নিকট সোপর্দ করলাম। এটাই ছিল তাঁর প্রথম কুরবানী। এটাই হলো তাঁর প্রথম ছুরি চালানো যা তিনি পিতৃপুরুষের অন্ধ অনুকরণ, বংশীয় ও জাতীয় গোঁড়ামীর উপর এবং নিজের প্রবৃত্তির সে সকল দুর্বলতার উপর চালিয়েছেন, যার কারণে মানুষ নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে নিজ পরিবেশ ও সমাজের সাথে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। তখন পরিবেশ ও সমাজ তার তাগুত সেজে বসে। এ সুযোগে তাগুত মানুষের প্রতিটি বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়। যেমন ‘নাফস’ এক ধরণের তাগুত। মানুষের পুরো জীবনের লাগাম নাফস নামক তাগুতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় তার সামগ্রিক কর্মকান্ড তাগুত তার খেয়াল-খুশি মত পরিচালনা করে।
দ্বিতীয় কুরবানী ঃ দ্বিতীয়ত একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েমের নিমিত্তে নিজের দেশ ও জাতিকে অসংখ্য মিথ্যা রবের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এজন্য মানুষকে দাওয়াত প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ জন্য কায়েমী স্বার্থবাদীসহ দুনিয়ার তাবত তাগুতী শক্তি কমর বেঁধে বিরোধিতায় নেমে যাবে। হেন অস্ত্র নেই যা তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না। তখন আল্লাহতে পূর্ণ তায়াক্কুল রেখে নিজের গন্তব্য পানে পূর্ণ শক্তিতে ছুটে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে কোন প্রকার হতোদ্যম, হীনমন্যতা প্রকারান্তরে তাগুতকেই সাহায্য করার নামান্তর। হযরত ইবরাহিম (আ.) যে পরিবার ও সমাজ এবং পরিবেশে আগমন করেছিলেন তার পুরোটাই নাস্তিক ও শিরকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এমন কি রাষ্ট্রশক্তি পুরিপূর্ণভাবে নাস্তিক ও শিরকের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। তিনি আরো জানতেন যে তাওহীদের সন্ধান তিনি পেয়েছেন তা এরা কখনো মেনে নেবে না। বরং এ জন্য তাঁকে কঠিন নির্যাতন ও শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। তবু তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে উঠে দাঁড়ালেন। রাত-দিন তিনি কেবল একটি চিন্তা করতে থাকলেন, দুনিয়ার মানুষকে অসংখ্য রবের গোলামীর নাগপাশ হতে মুক্ত করে কীভাবে এক আল্লাহর বান্দায় পরিণত করা যায়। তিনি প্রথমে নিজের পিতাকে, নিজের খান্দানকে, নিজের জাতিকে, এমনকি রাজাকে পর্যন্ত নাস্তিক ও শিরক থেকে বিরত থাকতে এবং তাওহীদের আকীদা কবুল করতে দাওয়াত দিলেন। এর ফলশ্র“তিতে তিনি একদিকে একা অপরদিকে গোটা দেশ ও জাতি তাঁর মোকাবেলায় এক সারিতে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু এর পরও হতোদ্যম হননি, তার মুখ অবসন্ন হয়নি। তখন সিদ্ধান্ত হলো আগুনে পুড়িয়ে মারার। তাতেও তিনি বিরত হলেন না। বরং এ কাজের জন্য লেলিহান অগ্নিগর্ভে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে পছন্দ করলেন। এটা তাঁর দ্বিতীয় কুরবানী। সুতরাং প্রতিটি হজ্ব যাত্রী ও কুরবানকারীদেরকে যে কোন পরিবেশে নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদ ও তাওহীদের দাওয়াত দানের জন্য দাঁড়াতে হবে। সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকতে পারে। এ সমস্ত আশঙ্কার গলায় ছুরি চালাতে হবে।
তৃতীয় কুরবানী ঃ তৃতীয়ত নাস্তিক ও শিরকমুক্ত সমাজ কায়েমের আন্দোলনের জন্য নিজেদের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ ও লোভ-লালসার গলায় ছুরি চালাতে হবে। ইসলামের জন্য আল্লাহর জন্য প্রয়োজনে নিজের মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করার মানসিকতা থাকতে হবে। যুুগে যুগে কালে কালে আল্লাহর প্রিয়জনেরা এ পথ অবলম্বন করার অসংখ্য নজির দেখতে পাওয়া যায়। মানবতার মহান বন্ধুকেও (সা.) এ পথ অবলম্বন করতে দেখেছি। হযরত ইবরাহিম (আ.) আগুন থেকে বাঁচার সম্ভব হলো না। তাওহীদের জন্য তিনি বহিষ্কৃত জীবনই পছন্দ করলেন। তাওহীদের দাওয়াতের জন্য তিনি দেশের পর দেশ ঘুরতে থাকলেন। কিন্তু চারদিকে নাস্তিক ও শিরক আর শিরকের অনুসারী থাকায় কোথাও তিনি ঠাঁই পেলেন না। তিনি সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর ও হিযাযে গিয়েছেন। মোট কথা আরাম আয়েশকে পিছনে ঠেলে দিয়ে গোটা জীবনই দেশ দেশান্তরের মাটি যাচাই করেছেন। নিজ বাড়ি, খেত-খামার, পশু ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবই তো ছিল। কিন্তু এগুলোর প্রতি লোভাতুর হননি। তাওহীদের পতাকা উড্ডীন করার দুর্বার স্পৃহা তাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরিয়েছে। এ টি তাঁর তৃতীয় কুরবানী। আমাদেরকেও নিজ বাড়ি, খেত-খামার, পশু ও ব্যবসা-বাণিজ্যের লোভকে সংবরণ করে তাওহীদের পতাকা উড্ডীন করার নিমিত্তে দাঁড়াতে হবে।
শেষ ও চূড়ান্ত কুরবানী ঃ দেশত্যাগ ও নির্বাসনের দু:খ-কষ্ট ভোগ করার পর বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ্ তাকে সন্তান দান করলেন। তিনি তাঁর জন্যও একই ধর্ম ও কর্তব্য ঠিক করলেন। সব কঠিন পরীক্ষায় পাস করার পর আরো একটি পরীক্ষা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হযরত ইবরাহিম (আ.) সবকিছু অপেক্ষা রাব্বুল আলামীনকেই বেশি ভালবাসেন কিনা, তার ফয়সালা হতে পারত না। তাই বৃদ্ধ বয়সে একেবারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তার সন্তান লাভ হয়েছিল সে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে পারেন কি না তারই পরীক্ষা নেয়া হলো। পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন। তখন চূড়ান্তরূপে ঘোষণা করা হলো যে, এখন তুমি প্রকৃত মুসলিম হওয়ার দাবীকে সত্য বলে প্রমাণ করেছ। এক্ষণে তোমাকে সারা পৃথিবীর ইমাম বা নেতা বানানো যায়। আল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে: ‘‘এবং যখন ইবরাহীমকে তাঁর রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় ঠিকভাবে উত্তীর্ণ হলেন তখন তাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের ইমাম বা নেতা নিযুক্ত করছি। তিনি বললেন, আমার বংশধরদের সম্পর্কে কি হুকুম? আল্লাহ তায়ালা বললেন জালেমদের জন্য আমার ওয়াদা প্রযোজ্য নয়।’’ (সূরা ২ বাকারা, আয়াত: ১২৪)
এ আয়তের আলোকে প্রশ্ন রাখতে চাই কারা আজ সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে? আর কেনই বা এমনটি হলো? এর উত্তর খুব সহজ। তাহলো আমরা প্রথম তিনটি কুরবানীর প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে প্রতিবছর কুরবানী করে থাকি। এটি উল্লিখিত আয়াতের আলোকে নিজের ওপর এক মস্তবড় জুলুম। আল্লাহর ওয়াদা কখনো জালিমের জন্য প্রযোজ্য নয়। নিজেদের জুলুমের পরিণাম হিসেবে পৃথিবীর নেতৃত্ব আজ অন্যদের হাতে চলে গেছে। ইসলামের অন্যান্য ইবাদাতের মতই এটি একটি স্রেফ আনুষ্ঠানিক আনন্দ-ফূর্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হজ্ব ও কুরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আজ নি®প্রভ এক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। এ সংকট উত্তরণের জন্য আমাদেরকে কাল বিলম্ব না করে এখনি প্রথম তিনটি কুরবানীর দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। নিজের সকল প্রকার চেষ্টা ও সাধনাকে সে দিকে কেন্দ্রিভূত করতে হবে। এ আলোচনায় আমরা একটি বিষয় বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি, তা হলো, ‘নাস্তিক ও শিরক’। কুরবানী ও গোটা হজ্বের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘নাস্তিক ও শিরক’ উচ্ছেদ। সুতরাং আসুন নিম্নলিখিত শিক্ষাগুলো প্রথমত নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করি, দ্বিতীয়ত: দেশ ও জাতির চরিত্রকে নাস্তিক ও শিরকমুক্ত করে তাওহীদের দিকে নিয়ে যাই।
নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদ করা: নাস্তিক ও শিরক দু’টি জুলুম। নাস্তিক ও শিরকের গুনাহ আল্লাহ তা’আলা তাওবা ছাড়া কখনো মাফ করবেন না। নাস্তিক ও শিরক সমস্ত নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ নাস্তিক শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ নাস্তিক ও শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ পূর্বেই বলা হয়েছে যে, নাস্তিক ও শিরকমুক্ত জীবন ও সমাজ গঠন করার জন্যই হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাছাড়া হজ্বের মৌসুমে মহান আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হিসেবে তালবিয়া পাঠে বলা হচ্ছে ‘‘আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নাই, আমি তোমারই নিকটে এসেছি। তুমি একক-কেহই তোমার শরীক নাই।’’ এ কথাটিকে বাস্ত জীবনে রূপায়ন করতে হবে। অন্যথায় এটি এক ধরণের মোনাফেকী আচরণ হবে।
দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে, পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা: জন্মসূত্রে মুসলমান নয় বরং একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে, সারাজাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, নিজেকে তার নিকট সোপর্দ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শুধু মাত্র পাঁচওয়াক্ত নামাযে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করা হলো কিন্তু জীবনের বিশাল অংশকে মানুষের তৈরি আদর্শের হাতে সোপর্দ করলে তিনি মুসলিম নন বরং একজন খাঁটি মুনাফিক। প্রতি নামাযেই অসংখ্য বার বলা হচ্ছে; ‘‘আমরা তোমারই গোলামী করি আর তোমারই সাহায্য চাই’’। অথচ নামাযের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। এ এক মিথ্যাচার ছাড়া কি হতে পারে? আর এ মিথ্যাচারকে বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে বলা হয়: ‘‘হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নাই, আমি তোমারই নিকটে এসেছি। সকল প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্যে। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক-কেহই তোমার শরীক নাই।’’ অথচ বাস্তবক্ষেত্রে তার বিপরীত কার্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরণের দ্বিমুখী নীতি বা মুনাফেকী আচরণ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাস্তবক্ষেত্রে নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদ করে আল্লাহর সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার কোন প্রচেষ্টা ও ভূমিকাই আমাদের না থাকে, তবে আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হয়ে যতই তালবিয়া পাঠ তথা ‘লাব্বায়িক’ বলা হোক না কেন, আল্লাহর হাজিরা খাতায় তাকে অনুপস্থিতই ধরা হবে। কারণ তার কথা ও কাজে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হজ্ব ও কুরবানী চেতনার অনুধাবন করা: প্রথমেই বলা হয়েছে যে, হজ্বের অনুষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে রেখে পালন করতে হবে। আর এ চেতনাকে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) ন্যায় নাস্তিক ও শিরক উচ্ছেদ এবং মানুষকে অসংখ্য মিথ্যা রবের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার আপোষহীন সংগ্রামের কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং এ সংগ্রাম নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই হজ্ব ও কুরবানীর সার্থকর্তা ও সুফল পাওয়া যাবে। আল্লাহ্ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন।