বর্ষায় ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন দুর্গম অরণ্যে হামহাম

134

বাবরুল হাসান বাবলু, কমলগঞ্জ থেকে :
‘আ-ম আ-ম’ মানে সিলেটের স্থানীয় ভাষায় পানির পড়ার তীব্র শব্দ। আর এই ‘আ-ম আ-ম’ শব্দ থেকেই TEQQমূলত “হামহাম” বলছিলাম মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কুরমা বনবিটের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গহীন বনের ভেতর ভারতের ত্রিপুরা সংলগ্ন পাহাড়ি ঝর্নার কথা। ২০০৬ সালে বাঁশ কাটতে গিয়ে স্থানীয় একদল শ্রমিকের আবিষ্কার “হামহাম’’।
ঝর্ণার আসল রূপ বর্ষায়। তাই বৃষ্টি মুখর দিনে বহুগুণে বেড়ে যায় প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া হামহাম জলপ্রপাতের। দুর্গম পথের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে ঘুরে আসতে পারেন হামহাম ঝর্ণা সাথে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে সিতাপ ঝর্ণা।
শ্রীমঙ্গল পানসি রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তাটা সেরে সকাল সকাল চান্দের গাড়িতে রওয়ানা কলাবনপাড়া। পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা ধরে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান পিছনে পেলে ক্রমশ চান্দের গাড়িটা এগিয়ে চলছে। ভানুগাছ বাজার, আদমপুর বাজার পিছনে ফেলে চাম্পারাই চা বাগানের দৃষ্টি নন্দন সবুজ একটি কুড়ি দুটি পাতা দেখতে দেখতে সোনরাই চা বাগানে এসে গাড়িটা থেমে যায়। বর্ষায় বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তা নষ্ট। দেড় কিলোমিটার চা বাগানের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে কলাবন পাড়া। গাড়ি থেকে নেমে ব্যাকপ্যাক কাদে তোলে হাটা শুরু।
বেশি দুর নয়, পনেরও বিশ মিনিট হাঁটা পথ। কলবান পাড়াই সম্ভবত শেষ বসতি। এর পর আরে কোন বসতি নেই এই অঞ্চলে। এক সময় হয়তো অতিরিক্ত কলাগাছ ছিল এই এলাকায় সে থেকেই হয়তো নাম করণ হয়েছিল কলাবনপাড়া। এখন কলাবনপাড়া আছে কলা নেই গাছও নেই। গ্রামের মধ্যে খুব ছোট দু’একটি দোকান কিছু পানি ও কিছু বিস্কুট ছাড়া অন্যকোন খাবার নেই। বনের মধ্যে জোক থাকায় জোকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হাত মোজা, পামোজা দিয়ে নিজেকে আবৃত করে অনেকে। ততক্ষণে সকাল ১০ টা। আমাদের যাত্রা শুরু। বনের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্বে বিজিবির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সারি বদ্ধভাবে এক এক করে হাঁটা শুরু উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ। বনে ঢুকেই চোখে পড়ে সেগুন, জারুল, ডুমুরের গাছ। বনে বনে উড়তে থাকে রং বেরংয়ের প্রজাপতি। গাছের শাখা আর বেত বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় চশমা পরা দুষ্ট হনুমানের লাফালাফি। বনের অচেনা পাখির ডাক, অচেনা পথ, অচেনা জীব জন্তু মানেই কিছুটা শিহরন। ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি আরও নাম না জানা বাঁশবন পেরিয়ে আকাঁবাঁকা উঁচু নীচু পথ চলে গেছে দূর বহুদূরে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পথ পিচ্ছিল। পা ধরার মত না। লাঠি ভর দিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে সবাই। আমি প্রথম থেকেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম এ যাত্রাটা যতই দুর্গম হোক লাঠি ছাড়া যাওয়া যায় কিনা। তাই লাঠির আশ্রয় নেই নি। কখনো ডালু পথ পাড়ি দিচ্ছি কখনো খারা পাথ ধরে উঠে যাচ্ছি ঠিলার উপরে। দু’এক জন পথের ক্লান্তিতে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছেন অনেকে ধীরে, ধীরে হাঁটছেন। আমাদের দলে ছিলাম ২৬ জন। শুক্রবার বন্ধের দিন থাকায় সে দিন হামহাম দেখতে অনেক লোকজন এসেছিলেন এ পথে। যারা ভাল হাটতে পারেন তারা সামনে চলে যাচ্ছেন যারা হাটতে অভ্যস্ত নয় তারা পিছনে পরে যাচ্ছেন। বনের মধ্যে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় এসে পিছনে চেয়ে দেখি আমার সাথে কেউ নেই। সবাই অনেকটা ফিছনে রয়ে গেছেন। পথ অচেনা তাই একা একা হাঁটতেও ভয় পাচ্ছিলাম। কিছু সময় পর পিছন থেকে স্থানীয় দু’জন লোক এসে যোগ দিলেন। আমিও হাঁটতে শুরু করলাম তাদের সাথে। বনের ভেতর অচেনা মানুষের সাথে হাঁটতে সহসা সাহসও পাচ্ছিলাম না। কিভাবে গল্পটা শুরু করবো অপরিচিত লোকটির সাথে। এক সময় নিজ থেকেই শুর করলাম। ভাই কি হামহাম যাচ্ছেন। জ্বি হামহাম যাচ্ছি। আমার সেখানে একটি চায়ের দোকান আছে। এভাবেই কথা বলতে বলতে হামহাম সম্বন্ধে আনু ভাইয়ের কাছ থেকে “হামহাম’’ জানা। আনু ভাই সহজ সরল মানুষ। ২০০৬ সালে তিনি কিছু দিন গাইডের কাজ করেন। গাইডের কাজ করতে গিয়ে এক সময় তিনি অনুভব করেন বনের গহীনে এসে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। পানির কষ্ট করেন, খাবারের কষ্ট করেন। এ চিন্তা থেকেই তিনি বনের গহীনে এক টুকরো সামান্য পলিথিন টাঙ্গিয়ে চায়ের দোকান শুরু করেন। আজও যাচ্ছেন দোকানে সামন্য কিছু ডিম নিয়ে। সবাই চলে আসলে তিনিও চলে আসবেন। হাঁটতে হাঁটতে আনুভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে ঘুরে ফিরে হামহাম’’ আনু ভাই এই হামহামটা কে আবিষ্কার করে বলতে পারেন ? তিনি আবারো গল্পটা শুরু করলেন, আমি হাটতে হাটতে শুধু শুনে যাচ্ছিলাম আর মাঝেমধ্যে দু’একটা প্রশ্ন করছিলাম। এই যে সারি সারি বাঁশ দেখতে পাচ্ছেন এই সারি সারি বাঁশ লুকিয়ে লুকিয়ে কাটতে আসে বাঁশ শ্রমিকরা। ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে বাঁশ কাটতে এসে শ্রমিকরা হয়তো এই ঝর্ণাটির সন্ধান পায়। সে সময় ঝর্ণাটির সন্ধান পেলেও তা কিছু সংখ্যক মানুষের কাছেই জানা ছিল। ২০০৬ সালে ইসলামপুর বাজারের মৃদুল সিংহ ভাই আমাকে এই ঝর্ণায় নিয়ে আসেন। পথে হাঁটতে হাঁটতে বলেন চল এই ঝর্ণাটির ছবি তোলে ইন্টানেটে ছড়িয়ে দেই। তখন ইন্টারনেট কি আমি জানতাম না। সেদিন আমি মৃদুল ভাইয়ের সাথে প্রথম ঝর্ণাটি দেখতে আসি। তিনি ঝর্ণাটির ছবি তোলেন এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। তারপর থেকে দেখি ধীরে ধীরে এই এলাকায় ঝর্ণা দেখতে লোকজন আসা শুরু করেন।
পথে যেতে যেতে আনু ভাই বার বার শুধরে নেন আপনি কি আমার সাথে হাঁটতে পারবেন। সহসা উত্তর যতটুক যেতে পারি। যেতে যেতে উঁচু নীচু ডালু পথ পাড়ি দিয়ে এক সময় নেমে পড়ি বাঁশের ছাউনির ভেতর ঝিরি পথে। প্রবল বেগে পানি নামছে। ঝিরি পথের বড়-বড় পাথরে বাধা পড়ে পানি আরো শব্দ তোলে প্রবল গতিধারায় আরোও নীচে নেমে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ যতই ঝিরি পথটা পাড়ি দিচ্ছি ততই ’আমাম’ ’আমাম’ শব্দটা স্পস্ট শুনতে পাচ্ছি। ঝিরি পথের জল ও জলের গতি আরও বাড়ছে ততই স্পট হয়ে উঠছে শত ফুট উপড় থেকে আঁছড়ে পরা পানি দৃশ্য। যা ক্যামেরার চোখে কখনো ধরা যায় না। ছায়া সুশীতল এ বনে জল প্রপাতের বাষ্পিভূত জল প্রখর রোদ্দুরে হিমশীতল করে দেয় ঘামের শরীর।
আনু ভাইয়ের দোকানের বাঁশের তৈরী বেঞ্চে বসে জলপ্রপাতে পর্যটকদের জলের সাথে অবগাহন দেখতে দেখতে লেবু আদার দু’কাপ চা,সাথে এক টুকরো বিস্কুট শরীর কিছুটা চাঙ্গা করে। পায়ের মধ্যে কখন জোক ধরেছে খেয়ালই নেই। আনু ভাইয়ের ছেলে সেটা সাড়িয়ে দিল।
এই সব দেখতে দেখতে ঝর্ণার জলে জল ভাস্পিভূত হতে হতে ভিজে যাওয়া একটি খাতা আনুভাই হাতে ধরিয়ে দেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখি যারা এই দুর্গম অরণ্যঘেরা জলপ্রপাতে এসেছেন তাদের মধ্যে অনেকে ভাল মন্দ লিখেছেন, আমিও লিখলাম। আনু ভাই ইতি মধ্যে একটি খাতা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একজন আত্মীয় মাধ্যমে জমা দিয়েছেন। হাজারো পর্যটকের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া এই খাতাটিও জমা দেয়ার সময় হয়ে আসছে। এ কথা বলতে বলতে তিনি বনের মধ্যে ফেলে যাওয়া ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরেন। তিনি হয়তো খাতায় রেখে যাওয়া স্বাক্ষরে-স্বাক্ষরে নিজেকে জানান দিতে চান আমি হামহামে একজন চা দোকানদার হলেও এই হামহাম আমার রুটি রুজির স্থান, আমি প্রকৃতির সন্তান এই প্রকৃতিকেই আমি ভালবাসতে চাই।
গল্প করতে করতে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দলের কাউকে দেখতে না পেয়ে আনুভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খারা ঢালু পথ বেয়ে বাঁশ বন ধরে ঝর্ণাটার উপরে উঠে ঝিরিটা দেখে আবরো নীচে নেমে যাই। ততক্ষণে দলের দু’একজন করে আসছে আর পথের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে ঝর্ণার জলে ঘা ভিজিয়ে নিচ্ছে। পথ খুব খারাপ থাকায় ”রাই” দম্পতি ঝিরি পথে নামার আগেই ফিরে গেছেন। জলের মধ্যে জল গড়িয়ে পরায় জলে গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় সাতার না জানা ডাক্তার ’’¯েœহাল সুমন’’ জলে পরে কিছুটা জল খেল। একজন থাকে উদ্ধার করলো। ততক্ষণে বিকেলের রোদ বাঁেশর ফাঁকে ফাঁকে ঝর্ণায় এসে সাতরং রঙধনু তোলে  একাকী হল ’হামহাম’। সবার পিছনে আবারো ঝিরি পথটা ধরলাম। মায়া পরে রইলো বনে বনে। হাঁটতে হাঁটতে বনের মধ্যে অন্ধকার নামতে নামতে ক্লান্ত, শ্রান্ত ট্রেকার সাজেদা আফরিন দম্পত্তি ’ভাই সাথে নিয়ে যাইয়েন’। অন্ধকার নামার আগে কলাবনপাড়া। সোনারাই চা বাগান পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে ভুল পথে কিছুটা হাঁটা, আবার পুরনো পথে ফিরে যাওয়া। সোনারাই বাজারে আদিবাসী তরুণীর জিজ্ঞাসা ”হামহাম” গেছিলেন ? কেমন লাগলো ? ভাল। তারপর নাগরিক জীবনের দিকে ছুটে চলা। একটা তারাভরা আকাশ নিয়ে কিংবা মেঘে ভরপুর আকাশ নিয়ে।