সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিবাজ পাউবো কর্মকর্তা, দুর্নীতিবাজ ঠিকার ও পিআইসির কারণে জেলার একমাত্র বোরো ফসল পনিতে তলিয়ে যায়। হাওরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর মামলা দায়েরের পর কিছুটা স্বজি ফিরছে মানুষের মনে। তবে তারা কি তাদের ফসলের ক্ষতিপূরণ পাব?। মামলার আসামিদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। মামলায় ঠিকাদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আসামী করা হলেও আসামী করা হয়নি এমপি ও উপজেরা চেয়ারম্যান মনোনীত পিআইসি সদস্যদের। মামলার হওয়ার পর দুর্নীতিবাজ তকমা নিয়ে অধিকাংশ ঠিকাদার গা ঢাকা দিয়েছেন। অন্যদিকে মামলায় আসামি হওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও পলাতক থাকায় সুনামগঞ্জ পাউবো অফিসে কারো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার আসামি হওয়ায় কয়েকজনকে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।
রবিবার সুনামগঞ্জের ৪৫ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপল, আ.লীগ ঘরানার ঠিকাদার সজিব রঞ্জন দাস, যুবলীগের সাবেক সদস্য পার্থ সারথী পুরকায়স্থ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য বিপ্রেশ রায় বাপ্পী, আ’লীগপন্থী মিলন কান্তি দে-এর কথা ছিল মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির দুর্দিনে বর্তমান জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আ’লীগ ঘরানার সঙ্গে মিশে গিয়ে হাওর গিলে খাওয়ায় শরিক হয়েছিলেন তাদের মধ্যে আসামী হয়েছেন, সুয়েব আহমদ, আকবর আলী ও নাসিম উদ্দিন লালা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপল, চেম্বারের সহ-সভাপতি সজিব রঞ্জন দাস সোমবার সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স ভবনে আসেননি। তাদের অবস্থানও কেউ জানাতে পারেননি।
আরেক আলোচিত ঠিকাদার পার্থ সারথি পুরকায়স্থও বাসায় নেই বলে জানা গেছে। তাকে বাসায় খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। বিএনপিপন্থী অভিযুক্ত ঠিকাদারদের শহরে দেখা যায়নি। অন্য ঠিকাদারদের অবস্থাও একই। কেউ প্রকাশ্যে আসছেন না।
জেলা পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান সাংবাদিকদের জানান, সদর থানায় মামলা হলেও এর তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এবছর পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণের কারণে পাউবো’র নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে জেলার সবকটি হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। অভিযোগ উঠে পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসি’র বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতির কারণে বাঁধ ভেঙে ফসলহানির। পরে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। হাওরে ফসলডুবির ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন হয়। দুদকের তদন্ত চলাকালেই পাউবো’র তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে গত রবিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে পাউবো কর্মকর্তা, ঠিকাদারসহ ৬১জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পরই সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বরখাস্তকৃত) আফসার উদ্দিন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মো. বাচ্চু মিয়াকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। অন্য আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে ঢাকায় দুদকের তরফ থেকে জানানো হয়।
এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের ৮৪টি অসমাপ্ত কাজ নতুনভাবে দরপত্র আহ্বান ছাড়াই এ বছর আগের ঠিকাদারদের দেওয়া হয়েছে। এ বছর ৭৬টি কাজের মধ্যে ৯টি বাঁধের কোনো কাজই হয়নি। বাকি কাজ আংশিক করার মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে।
আসামির তালিকায় পাউবোর ১৫ জন ছাড়া সুনামগঞ্জের ১৩ জন, ঢাকার ৯ জন, সিলেটের ৬ জন, কুমিল্লার ৩ জন, চট্টগ্রামের ২ জন, মৌলভীবাজারের ২ জন, সাতক্ষীরার ২ জন, টাঙ্গাইলের একজন, ফরিদপুরের একজন, পটুয়াখালীর একজন, খুলনার একজন, ময়মনসিংহের একজন, হবিগঞ্জের একজন, রাজশাহীর একজন, কুষ্টিয়ার একজন, চুয়াডাঙ্গার একজন ঠিকাদার রয়েছেন।
জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স নূর ট্রেডিং। এবার ওই প্রতিষ্ঠান কাজ পায় তিনটি। গতবার পেয়েছিল দুটি। সুনামগঞ্জ চেম্বারের সহ-সভাপতি সজিব রঞ্জন দাশ এবার পেয়েছিলেন সাতটি হাওরে ৯টি বাঁধের কাজ। এর মধ্যে দুটি বাঁধের কোনো কাজ তিনি করেননি। গতবার তিনি পেয়েছিলেন তিনটি বাঁধের কাজ।
সুনামগঞ্জের দুই ঠিকাদার কাজী নাসিম উদ্দিন এবার তিনটি, গত বছর একটি বাঁধের কাজ পেয়েছিলেন। সোয়েব আহমদ এবার পেয়েছেন চারটি বাঁধের কাজ। গত বছর তিনি পেয়েছিলেন একটির কাজ।
জানা গেছে, অভিযুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে খন্দকার শাহীন আহমদের বাড়ি ফরিদপুরের গোয়ালচামট এলাকার। তিনি এবার আটটি হাওরের ফসল রক্ষায় ৯টি বাঁধ নির্মাণের কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচটি বাঁধে কোনো কাজ করেননি। এই ঠিকাদার গত বছরে কাজ পেয়েছিলেন পাঁচটি বাঁধের। কিন্তু কোনোটির কাজই শেষ করেননি।
আরেক আলোচিত ঠিকাদার গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী হলেন টাঙ্গাইল জেলার আকুর-টাকুর পাড়ার মো. আফজালুর রহমান। এই ঠিকাদার এবার তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে তিনটি হাওরে সাত বাঁধের কাজ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনি একটি বাঁধের কোনো কাজ করেননি। গত বছর তিনি একইভাবে সাত বাঁধের কাজ পেয়ে কোনো কাজই পুরোপুরি শেষ করেননি। অভিযোগ আছে, গ্রেপ্তার হওয়া পাউবোর প্রকৌশলী মো. আফসার উদ্দিন নিজে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
দুদকের মামলায় অভিযুক্ত সুনামগঞ্জের মেসার্স মালতী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য বিপ্রেশ রায় বাপ্পী এবার পেয়েছিলেন তিনটি বাঁধের কাজ।
এদিকে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অফিসে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এ কারণে কর্মকর্তা শূন্য হয়ে পড়েছে পাউবো অফিস। মামলায় আসামি হয়ে অনেকেই পলাতক বলে জানা গেছে।
পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক ভূঁইয়া জানান, সুনামগঞ্জ অফিসের ১০ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর ৮ জন দুদকের মামলায় আসামি হওয়ায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীও মামলার আসামি হওয়ায় তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য যারা আছেন, তাদের মধ্যেও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী লিংকন সরকার, অনিক সাহা ফোনই ধরছেন না।