পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ থেকে :
আজ ২৫ নভেম্বর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ১৭৩ তম মাধবপুর জোড়া মন্ডপে মণিপুরীদের মহারাসলীলা ও আদমপুর মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের ৩০ তম মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছর পূর্ণিমা তিথিতে স্বাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণময় শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাহারাস লীলা উৎসব। মণিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও মাধবপুরে আশ্বিন মাসের শুরু থেকেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। উপজেলার মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে এ আনন্দ উৎসবের। দেশের বিভিন্ন স্থান সহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন সহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসেন মহারাসলীলা অনুষ্ঠান উপভোগের জন্যে। মণিপুরী সম্প্রদায় অধ্যুষিত কমলগঞ্জের আদমপুর ও মাধবপুরের রাসোৎসবের জন্যে তৈরী মন্ডপগুলো সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিশু নৃত্য শিল্পীদের সুণিপুণ অভিনয় যেন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছিল দর্শনার্থীর সমাগম। ২৫ নভেম্বর এ মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে।
মনিপুরীদের মহারাস বলতে প্রেমরসকে বুঝানো হয়। বস্তুত রস শব্দ থেকেই রাস শব্দটির উৎপত্তি। রস আস্বাদনের জন্য রাধাকৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্য গীতের মাধ্যমে যে উৎসব উদযাপন করা হয় তাই রাসোৎসব। নৃত্য, সংগীতে মণিপুরীদের প্রাচীন জাতীয় লোক নৃত্য ‘লাই হারাওবা’ থেকেই রাস নৃত্যের সৃষ্টি। জানা যায় ১৭৭৯ খৃস্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যে নৃত্য গীতের প্রবর্তন করেছিলেন তা-ই রাস নৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশত বছর পরে মহারাজ চন্দ্র কীর্তির শাসনামলে গোটা রাস নৃত্য আচৌকা ভঙ্গী, বৃন্দাবন ভঙ্গী, খুডুম্বা ভঙ্গী, গোষ্ট ভঙ্গী, গোষ্ট বৃন্দাবন ভঙ্গী, আচৌবা, বৃন্দাবন ভঙ্গী তান্ডব পর্যায়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, মহারাজ ভাগ্য চন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশিরভাগই ছিলেন নৃত্য গীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাস নৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এর ফলে মনিপুরীরা এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই ১৯৪২ খৃস্টাব্দ থেকে আজও কোনও রূপ-বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে এ রাস উৎসব। মনিপুরী এ নৃত্যকলা শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
কার্তিক মাসের প্রথম থেকেই চলে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়েছিল। কিশোরীরা রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে এবং রাখাল নৃত্যের শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। রাখাল নৃত্য সাধারণ দিনের বেলায় অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগেই অনুষ্ঠিত হয়। এদের পরনে ছিল ধুতি, মাথায় ময়ূর, পালকের মুকুট, কপালে চন্দ্রের তিলক, গলায় সোনার মালা, হাতে বাঁশি ও পায়ে নূপুর। এরপর বাঁশি হাতে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অনূকরণে একজন শিশু শিল্পী মাঠে প্রবেশ করে। অনেকক্ষণ ধরে চলে এই নৃত্য গীতি। রাতে শুরু হয় মহারাস লীলা। শুরুতেই পরিবেশিত হয় রাসধারীদের অপূর্ব মৃদঙ্গ নৃত্য। মৃদঙ্গ নৃত্য শেষে প্রদীপ হাতে নৃত্যের তালে তালে সাজানো মঞ্চে প্রবেশ করেন শ্রী রাধা সাজে সজ্জিত একজন নৃত্যশিল্পী তার নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় মনিপুরী বন্দনা সঙ্গীত। শ্রী কৃষ্ণ রূপধারী বাঁশী হাতে মাথায় কারুকার্য খচিত ময়ুর পুচ্ছধারী এক কিশোর নৃত্য শিল্পী তার বাঁশির সুর শুনে ব্রজ গোপী পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রী রাধা মঞ্চে আসেন। শুরু হয় সুবর্ণ কংকন পরিহিতা মনিপুরী কিশোরীদের নৃত্য প্রদর্শন।