গোলাপগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
ফ্রান্সের প্যারিস শহরে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন গোলাপগঞ্জের এক যুবক। সে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের লালনগর গ্রামের তোতা মিয়ার পুত্র তারেক আহমদ (৪০)। ভয়াবহ এই হামলায় তারেকের কর্মস্থল বাতাক্লুঁ থিয়েটারে চোখের সামনে হামলাকারীদের গুলিতে ঝাঝরা হতে দেখেছেন সহকর্মী নাতালিকে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যু আর আতংকের শহরে পরিণত হওয়া প্যারিসের বাতাক্লুঁ থিয়েটারে নাতালির মত আরো ৮৯ জনকে মর্মান্তিকভাবে নিহত হতে দেখেন তারেক। এদের বেশীর ভাগই থিয়েটারে চলা ব্যান্ড শোর দর্শকশ্রোতা। প্যারিস থেকে বাংলাদেশী সাংবাদিক এনায়েত হোসেন সোহেল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা তারেকের বরাত দিয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। শুক্রবার প্যারিসের বাতাক্লুঁ কনসার্ট হলের কফি বার স্থানীয় সময় তখন রাত ৯টা ৪৯ মিনিট। প্রতিদিনের মত বিকেলের শিফটে আপন মনে কাজ কাজ করছিলেন ২০০৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ভাগ্য উন্নয়নে ফ্রান্সে বসবাসকারী গোলাপগঞ্জের ছেলে তারেক আহমদ। ভয়াবহ বোমা হামলার রাতে তারেকের সাথে কাজ করছিলেন বারের শেফ ক্রিস্তফো, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বেখতন , ওয়েইটার মাকু ও ইবন। বারের সামনের অংশে বাতাক্লুঁ থিয়েটারে তখন চলছিলো মনমাতানো ব্যান্ড শো। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে ভড়কে যান সবাই। কোনো কিছু বুজে উঠার আগেই পুরো থিয়েটার গুলি আর বোমার শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তারেক তখন বারের দরজার ফাক দিয়ে উকি মেরে দেখতে পান হামলাকারীদের সন্ত্রাসী তান্ডব। তারেকের বর্ননায় , প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বেখতন আমাদেরকে নিরাপদে স্টোর রুমে ঢুকার নির্দেশ দেন। আমরা সাথে সাথে স্টোর রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দেই। সেই সাথে আল্লাহকে ডাকতে থাকি। এ সময় মানুষের গগনবিধারী চিৎকার আর সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শুনতে পাই। জীবনের প্রথম এ রকম পরিস্থিতির সামনে পড়ি। স্টোর রুমের ভেতরে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকি। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাদের পাশে বোমা ফুটবে ! আমাদেরকে তখন সাহস যোগান বেখতন। তিনি পুলিশের নিকট আমাদের অবস্থানের কথা মোবাইলে জানান। পুলিশ বেখতনকে আপাতত বার থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়। এক পর্যায়ে সবকিছু নিরব নিস্তব্দ হয়ে যায়। পরে প্রায় দেড় ঘন্টার পর পুলিশী সহায়তায় আমরা মুক্ত হই। এ ঘঠনায় তারকের কর্মস্থল বাতাক্লুঁ থিয়েটারে নিহত হয়েছে ৮৯ জন। তারেক আহমদ ১৯৯৩ সালে গোলাপগঞ্জের এম. সি. একাডেমি থেকে এসএসসি পাশ করেন ও সিলেট মদন মোহন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তিতে এইচএসসি ও ডিগ্রী পাশ করেন। ১ ভাই ও ২বোনের মধ্যে তারেক সবার বড়। জীবিকার তাগিদে ২০০৩ সাল থেকে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে বসবাস করছেন। তারেক জানান, বাতাক্লুঁ থিয়েটারের বারে আমি ৭ বছর ধরে একাধারে কাজ করে চলেছি। বিকেলের শিফটে প্রতিদিন ৫টা থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত কাজ করতাম।বিভিন্ন দেশের লোকজন এখানে কাজ করতো। একমাত্র বাংলাদেশী ছিলাম আমি।এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা গেছে। অনেকে আহত হয়েছে। বিশেষ করে থিয়েটারে কাজ করতো নাতালির মৃত্যুটা তারেককে বেশি কষ্ট দিয়েছে। চোখের সামনে নাতালিকে গুলি করতে দেখেন তারেক। কোনো কিছু বুজে উঠার আগেই ঝাঝরা হয়ে গেছিল তার শরীর। ওয়েটার লুই ও গুলি খেয়েছে তবে মারা যায়নি। গুরুতর আহত হয়ে ভাগ্য চক্রে বেঁচে গেছে। প্যারিসের লা প্লেইন রুই লান্দির ১২নং বাসায় স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় আলাপকালে তারেক আরো জানান, আমি বেঁচে আছি এটাই বিশ্বাস করতে পারছি না কি ভাবে বেঁচে গেলাম তা আল্লাহ জানেন। ঘটনার পর পরিস্থিতি শান্ত হলে পুলিশ এসে রেসকিউ করে তারেক সহ জীবিতদের। বর্তমানে তিনি সুস্থ্য আছেন তবে ঘটনার নির্মমতা তাকে এখনও তাড়িয়ে ফিরছে। উল্লেখ্য প্যারিসের ভিন্ন ভিন্ন ৬টি স্থানে শুক্রবার রাতে আত্মঘাতি বোমা হামলাও সন্ত্রাসীদের গুলিতে অন্তত ১৫০ জন মর্মান্তিকভাবে মারা যায়।