কাজিরবাজার ডেস্ক :
সদ্য সমাপ্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা এমনকি ভোটগ্রহণের দিনও তাদের আচরণ ছিল কৌশলী এবং রহস্যেঘেরা। ফলে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগে বিএনপির নির্বাচন বর্জনেও অর্জন করেছে তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত। ঢাকায় তিন এবং চট্টগ্রামে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর জয় তাদের অর্জনের বড় উদাহরণ- এমন অভিমত পর্যবেক্ষক মহলের। নজিরবিহীন কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে ২৮শে এপ্রিল দুপুরের মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু তারপরই নির্বাচন বাতিল এবং পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়ে কৌশলী বিবৃতি দেয় জামায়াত। এ ক্ষেত্রে বর্জন শব্দটি এড়িয়ে যায় তারা। ফলে দিনের শেষে জামায়াতের পাঁচ কাউন্সিলর প্রার্থীর জয় নিয়ে শুরু হয় আলোচনা- পর্যালোচনা। এ নিয়ে ২০দলীয় জোটের মধ্যে দেখা দেয় চাপা ক্ষোভ এবং অসন্তোষ। তবে কৌশলগত কারণে সে অসন্তোষ তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তিন সিটিতে মেয়র পদে কোন প্রার্থী ছিল না জামায়াতের। তবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ২৬টি কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে বিএনপির সঙ্গে টানাপড়েন চলে তাদের। শেষ পর্যন্ত এই টানাপড়েন চলতে থাকায় ২৬ কাউন্সিল প্রার্থীকে নিয়ে একলা চলা শুরু করে ২০ দলের শরিক দলটি। জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রে বিষয়টি স্বীকার করা হলেও কৌশলগত কারণে মন্তব্য করেননি কেউ। সংশ্লিষ্টরা জানান, মেয়র পদে জামায়াতের প্রার্থী না থাকায় ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ মিলে ৯৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬টি কাউন্সিলর পদ চেয়েছে তারা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ গত ১০ই এপ্রিল ২০দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীদের যে তালিকা প্রকাশ করে, তাতে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের কোন নাম ছিল না। আদর্শ ঢাকা আন্দোলন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৫ জন এবং দুই সিটির ৩১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ২৯ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। এতে জামায়াত যে ২৬টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে, তার ২৩টিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী দেখা যায়। এ নিয়ে জোটের মধ্যে মান-অভিমান শুরু হলে ১৫ই এপ্রিল ২০দলীয় জোটের প্রার্থী পরিচিতি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। তবে তার দু’দিন পর ১৭ই এপ্রিল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে ২০ দলীয় জোটের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায়ও জামায়াত প্রার্থীদের নাম দেখা যায়নি। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় জোটের শরিক বিজেপি, জাগপা, কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপসহ ৫/৬টি দলের প্রতিনিধি থাকলেও জামায়াতের কেউ ছিল না। ঢাকা মহানগর জামায়াতের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, এই নির্বাচনে সমন্বয়ের ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ এবং নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে জামায়াতের মহানগর সমন্বয়কারী নুরুল ইসলাম বুলবুল বহুবার যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এ পর্যায়ে বাধ্য হয়ে জামায়াত একলা চলা শুরু করে। দলের ২৬টি কাউন্সিল পদে প্রার্থীদের পক্ষে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যেখানে যেভাবে পারছেন নির্বাচনী প্রচার- প্রচারণা চালিয়েছেন। মেয়রপ্রার্থীসহ অন্য কোন কাউন্সিল প্রার্থী নিয়ে তাদের কোন তৎপরতা ছিল না। তবে আসম হান্নান শাহ এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ডিসিসি নির্বাচনে সমন্বয় করার জন্য আমি মহানগর জামায়াতের এক নেতাকে খবর পাঠিয়েছি তাদের দলীয় সাবেক এক কাউন্সিলরের মাধ্যমে। কিন্তু তারা কোন যোগাযোগ না করেই উল্টো আমাদের নামে ব্লেম দিচ্ছে। তারা (জামায়াত) আসলেই কিছু করছে না বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। ওদিকে নির্বাচনের দুই দিন আগে হঠাৎ মান ভাঙে জামায়াতের। দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে ২০দলীয় জোটপ্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ সর্বস্তরের ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান। ভোটের আগের দিন নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতির আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তার পরও ভোটগ্রহণের দিন ২৬ ওয়ার্ডের বাইরে জামায়াত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কোন ভূমিকা ছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। একই চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামেও। জামায়াত সূত্র জানায়, ২০০২ সালের ডিসিসি নির্বাচনে জামায়াত ৬টি কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়ে মতিঝিল এলাকার একটিতে জয়লাভ করে। এবার ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন গতবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর খন্দকার আবদুর রবের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা বেগম। এ ওয়ার্ডে তার বিপক্ষে লড়ছেন বিএনপির লোকমান হোসেন ফকির ও কাজী হাসিবুর রহমান। ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক তরুণ সদস্য বলেন, গত ডিসিসি নির্বাচনে যে সব ওয়ার্ডে আমাদের প্রার্থীরা ভাল করেছে ওইসব মিলিয়ে ২৬টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে জামায়াত। কিন্তু নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত বিএনপির তরফে কোন আলোচনা বা নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণী পরামর্শ করা হয়নি। এতে রাজধানীর ২৬ ওয়ার্ডের বাইরে জামায়াত কর্মী সমর্থকরা নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। সেখানে ৫৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলে ১০টি ওয়ার্ড জামায়াতকে ছেড়ে দেয় বিএনপি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নয়জন ও দক্ষিণে ১০ জন জামায়াত-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। তারা হলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডে আশ্রাফুল আলম, লস্কর মো. তাসলিম (ওয়ার্ড ৪), এনায়েত হোসেন (ওয়ার্ড ১৩), তারেক রেজা তুহিন (ওয়ার্ড ১৪), মোস্তাফিজুর রহমান (ওয়ার্ড ২২), মো. ইকবাল হোসেন (ওয়ার্ড ২৯), মনজুরুল আলম (ওয়ার্ড ৩৫), সালেহ সিদ্দিকী (ওয়ার্ড ৩৬), শরীফ মিজানুর রহমান (ওয়ার্ড ২৬)।
ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডে কবির আহমেদ, ৩ নম্বরে শহীদুল ইসলাম, ৫ নম্বরে উমর ফারুক মজুমদার, ৬ নম্বরে গোলাম শাফি মহিউদ্দিন, ১১ নম্বরে মোশাররফ হোসেন, ১৩ নম্বরে আঞ্জুমান আরা রব, ৩৯ নম্বরে আতাহার আলী, ৪৬ নম্বরে আবদুল মান্নান, ৫২ নম্বরে শফিকুল ইসলাম ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে আহমাদ হাসান। এছাড়া ঢাকা উত্তরে চারজন ও দক্ষিণে তিনজন নারীকে সংরক্ষিত ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থন দিয়েছে। তারা হলেন- উত্তরে উম্মে সালমা (৪, ১৫, ১৬ নং ওয়ার্ড), মাসুদা আক্তার (১২, ১৩, ১৪ নং ওয়ার্ড), আমেনা বেগম (২২, ২৩, ৩৬ নং ওয়ার্ড), কাওসার জাহান (২৯, ৩০, ৩২ নং ওয়ার্ড); দক্ষিণে শামিমা আকতার (২, ৩, ৪ নং ওয়ার্ড), দিলারা বেগম (১৩, ১৯, ২০ নং ওয়ার্ড) ও হাসনা হেনা (৫২, ৫৩, ৫৪ নং ওয়ার্ড)।
এদের মধ্যে ঢাকা উত্তরের ২২, ২৩ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনে ডা. আমেনা বেগম গ্লাস প্রতীকে ২৪ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। একই অংশের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাসুদা আক্তার ৩১ হাজার ৭৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ২৯.৩০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সংরক্ষিত আসনে কাওসার জাহান ১৬ হাজার ৮৭৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ওদিকে চট্টগ্রামের সাধারণ ওয়ার্ড ৩৭ মুনিরনগরে মো. শফিউল আলম ৪৫ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আর ৬ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ফারজানা ইয়াসমিন নিশাত ৩১ হাজার ৮০০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জামায়াত প্রার্থীদের এই বিপুল ভোটে বিজয়ে হতবাক হয়েছেন অনেকেই।