চর্যাপদ থেকে বিজ্ঞান, কবিতা, ভাষা ও সাহিত্যে সিলেট

369

হাসনাইন সাজ্জাদী

বা ংলাদেশের প্রান্তিক একটি জনপদ সিলেট। বাংলা সাহিত্যের জন্ম, দিক পরিবর্তন ও সমৃদ্ধি অর্জনে এই সিলেটের ভূমিকা গুরুত্বের দাবিদার। কিন্তু সে অর্থে সিলেটের এই অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। যে চর্যাপদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জন্ম। সে চর্যাপদের জন্ম কোথায়, জন্ম কাহিনীই বা তার কেমন? তাতো অনেকেই আমরা জানি না। প্রাচীনকালে যখন জাতপাতের লড়াই ছিল। ছিল, ধর্মে ধর্মে সংঘাত। এক ধর্মের উপর আরেক ধর্মের প্রাধান্য বিস্তারের এ লড়াই থেকেই চর্যাপদের জন্ম হয়। প্রাচীনকালের কাব্য ছিল ধর্ম ও দেবদেবী নির্ভর। মহাকবি হোমারের ইলিয়াড আর অডিসি ছিল দেবতাদের গুণকীর্তন নিয়ে লেখা। আর ভারতবর্ষের সকল কাব্যই তখন ছিল ধর্মকথা।
উচ্চ ধর্মের হিন্দু সমাজের সাথে বৌদ্ধ সহজিয়াদের সংঘাত থেকে বৌদ্ধরা ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ী সিলেট, বরাক, আসাম প্রভৃতি জনপদে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি! পালিয়ে বেড়িয়েছে তারা নেপাল পর্যন্ত। এর ভেতর দিয়ে তারা অনুভব করেছে এভাবে পালিয়ে ধর্ম রক্ষা হবে না। তাই বাণীকে লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রয়োজনকে তারা অনুভব করে। এই প্রয়োজনীয়তার অনুভব থেকেই সম্পন্ন হয় বাণী লিপিবদ্ধকরণ। তারা তাদের সাধন-ভজন পদ্ধতিকে সর্বভারতীয় বর্ণমালা দেব-নাগরীতে তখন লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে। চর্যাপদের ২৩-২৪ জন পদকারের নাম পাওয়া যায়। সিলেট, বরাক ও আসামের পাহাড়ী অঞ্চলে বসে রচিত বলে চর্যাপদে এতদাঞ্চলের মাটি ও মানুষের খন্ডচিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। চর্যাপদের রচনাকাল শুরু সপ্তম শতক থেকে এবং এর সমাপ্তিকাল ধরা হয় একাদশ শতক পর্যন্ত। এই একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যেই বাংলা লিপির উদ্ভব ঘটে। সে লিপি আজ বিশ্ব বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে একটি প্রিয় লিপি। বাংলা আজ বিশ্বে জয় করেছে আপন মহিমায়। চতুর্দশ শতকে তখনো বাংলা তত জনপ্রিয় হয়নি। দেব নাগরীর সাথে বাংলা লিপির তখন প্রতিযোগিতা চলছে। এমন সংকটকালে সিলেট, বরাক ও আসাম অঞ্চলের মানুষের হাতে সিলেটি নাগরী বলে একটি স্বতন্ত্র লিপির আবিষ্কার ঘটে। এতদঞ্চলের মানুষের নাগরিক চেতনা, ধর্ম ও  সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় যুক্ত হয় নতুন সাহিত্যিক মাত্রা। মধ্যযুগে বাংলালিপি বাংলার একটি বড় অংশে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে বসেছিল। তার মধ্যেও সিলেট নাগরী লিপিতে সিলেট, বরাক ও আসাম অঞ্চলের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয়তা মেটায় এবং এ লিপিতে পুঁথি সাহিত্য, ধর্মীয় নীতি কবিতা, মরমী সংগীত ও লোক সাহিত্যকে লিপিবদ্ধ করতে থাকে। মধ্যযুগ পর্যন্ত এ লিপির জনপ্রিয়তা এতদঞ্চলে ছিল প্রশ্নাতীত। প্রায় ৭ শত বছর এ লিপি যখন ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ও সমাদৃত তখন রাজনৈতিক হাওয়া পরিবর্তনও মানচিত্র বদলের ধাক্কা লাগে এ লিপির গায়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ধাক্কা বলবান হয় ভাষা সংকট থেকে। বাংলা ভাষাকে বাংলা-পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা না করার পশ্চিমী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র জন্ম দেয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা, রোমান হরফে বাংলা চালু ইত্যকার ষড়যন্ত্র থেকে জন্ম নেয়া ভাষা আন্দোলনের শেষ ধাক্কা এসে পড়ে সিলেটি নাগরী লিপির গায়েও। শেষ পর্যন্ত নাগরী লিপি এ ধাক্কা সামলাতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালার একচ্ছত্র আধিপত্য ও সিলেটি নাগরী লিপির পরাজয় একটি বর্ণমালাকে প্রায় লুপ্ত অবস্থায় পৌঁছে দেয়। অথচ সিলেট, বরাক ও আসাম অঞ্চলের ঘরে ঘরে চর্চা হত এ ভাষা ও লিপিতে সাহিত্য। গোলাম কাদির, মুছাব্বির ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ সাদিক তিনটি আলাদা আলাদা পিএইচডি গবেষণা করে নাগরী লিপি ও সাহিত্যের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের একটি ফার্সি ভাষায় লেখা দলিলের উপর বাংলা ইংলিশের পাশাপাশি সিলেট নাগরী লিপির ছাপও যে সমান্তরাল স্বীকৃত ছিল তা সম্প্রতি আমি গবেষক ও লেখক দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর কাছে সংরক্ষিত থাকতে দেখেছি।
নানা কারণে আজ সিলেটি নাগরী লিপি লুপ্তপ্রায় এবং যুদ্ধজয়ী বাংলা বর্ণমালা বিশ্বজয়ী ও বাংলাভাষা আজ বিশ্বভাষাদিবসের অলংকারে পরিণত হয়েছে।
বৈষ্ণব সাহিত্যে সিলেটের সংযুক্তি আরো রোমাঞ্চকর। পনের শতকে সিলেটের ঢাকাদক্ষিণে পিতার ঔরস থেকে মাতৃগর্ভে আসেন নিমাই সন্ন্যাসী ওরফে শ্রী চৈতন্য দেব। শেষতক জন্ম তার পিতার কর্মস্থল নবদ্বীপে।
কাটোয়ায় গিয়ে নিমাই সন্ন্যাসী বিষ্ণুর অনুসারী হন এবং প্রবর্তন ও প্রচার শুরু করেন বৈষ্ণব ধর্মের। তাকে কেন্দ্র করে তখন ১৪-১৫ হাজার পদাবলী রচিত হয় এবং তার মধ্যে ৬-৭ হাজার পদাবলী সাহিত্য মানের দিক থেকে খুবই উৎকর্ষ ছিল এবং তা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধি ও পূর্ণতা প্রদান করে। বলতে গেলে এই পদাবলী সাহিত্যই বাংলা সাহিত্যের প্রাণভমরা। মধ্যযুগের এই পদাবলী সাহিত্য অনুসৃত হয় নবধারার কাব্যযুগে এবং বিহারী লালের হাত দিয়ে গীতি কবিতায় তা উৎকর্ষতা লাভ করে। এ ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলী রচনা করে নোবেল পদক লাভ করেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী আধুনিক কাব্যযুগেও গীতি কবিতা তার জনপ্রিয়তা হারায়নি। তাই বলা যায় শ্রীহট্ট পুত্র শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য এত তাড়াতাড়ি এতটা সমৃদ্ধ হত না। এগোতে পারতা না এমন বিস্ময়কর সাফল্যের সাথে।
প্রাচীনকালের শেষ লগ্ন কিংবা মধ্যযুগের প্রথম দিকে আরেক শ্রীহট্র সন্তান সঞ্জয় গৌর মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত প্রতিলিপি হয়ে পড়ে এবং সঞ্জয় গৌরের কৃতিত্ব চুরি হয়ে যায়। আধুনিক কবিতার ধারার সিলেট সন্তান কবি দিলওয়ার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম।
ফ্রান্সের কবি শার্ল বোদলেয়ারই প্রথম পাপ, অন্ধকার ও তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু করেন আধুনিকতাবাদী কবিতা আন্দোলন। আমি (হাসনাইন সাজ্জাদী) যেমন হালে বিশ্বায়নের সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন করে চলেছি। সে কথায় পরে আসছি। বোদলেয়ার অনুসৃত আধুনিকতাবাদী কবিতাকে বঙ্গ ভারতে পরিচিত করেন বিশ শতকের ত্রিশের দশকের পঞ্চরতœ কবি বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাশ, অমীয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত ও বিষ্ণু দে। তাদের শ্লোগান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী, রবীন্দ্র উত্তর এবং শার্ল বোদলেয়ার অনুসৃত কবিতা হবে আধুনিক যুগ সমস্যার সমাধান। আমি (এই নিবন্ধকার) যেমন বলি বিজ্ঞান যুগের কবিতা হবে বিজ্ঞান কবিতা। বিজ্ঞান কবিতায় আমরা খুঁজবো যুগ সমস্যার সমাধান। কবি যেহেতু সত্যদ্রষ্টা, কবি ক্রান্তিদর্শী। তাই মানুষের দুঃখ যন্ত্রণাকে ধারণ করবেন কবি। কবি তার কবিতায় দেবেন যুগ সমস্যার আশু সমাধান। কবি শুধু কল্পনার সাগরে নিজেকে এবং তার পাঠকদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তাকে জাতির সমূহ বিপদ অনুধাবন ও এর সমাধান দিতে হবে। তবেই কবি হবেন জাতির সঠিক ও যোগ্য প্রতিনিধি।
সময়ের দিক থেকে বিজ্ঞান যুগ। ভাবের দিক থেকে বিজ্ঞান মনস্কতা, ভাষার দিক থেকে সর্বউৎকৃষ্টতা এবং ছন্দের দিক থেকে মুক্ত ছন্দের ব্যবহারিক প্রাগ্রসরতাই হবে বিজ্ঞান কবিতার মৌল-ভিত্তি। এই বিষয়টিকে খোলাশা করতে আমি বিজ্ঞান কবিতার রূপরেখা গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছি।
কবিতার ইতিহাসের পর্যাবৃত্তি (চবৎরড়ফরপরঃু) খুব স্পষ্ট। চর্যাপদ দিয়ে শুরু বাংলা কবিতা। এটাই প্রাচীন যুগ। তারপর মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ পার করে এখন বিজ্ঞান কাব্য যুগ শুরু হয়েছে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, বাংলা কাব্য সাহিত্যে চর্যাপদ, মঙ্গলবাক্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, পুঁথি সাহিত্য, পাশ্চাত্য অনুসৃত নব ধারার প্রাক আধুনিক সনেট যুগ, গীতি কবিতার যুগ হয়ে আধুনিক যুগে এগিয়ে গেছে ধারাবাহিকতার পথ পরিক্রমায় কবিতা। এখন কি? তারপর বন্ধ্যাত্ব কাল শুরু হয়েছে। উত্তর আধুনিক যুগ বলে যাকে অনেকে ভ্রমভাবে চিহ্নিত করে থাকেন। আসলে এ সময়টা বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মনস্কতা ছাড়া জাতি তার ভবিষ্যৎ মুক্তির পথ খোঁজে পাবে না। তাই বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গঠনের জন্য বিজ্ঞান চেতনার কবিতার কথা এখন বলা হচ্ছে। আন্দোলনও চলছে বিজ্ঞান কবিতার। বিশ শতকের আশির দশক থেকে শুরু হয় আমার হাতে ঢাকায় বিজ্ঞান কবিতার আন্দোলন। আর এখন বিশ্বময় তা ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে।  বাংলাদেশের কবিতার শূন্যদশক পুরোটাই ছিল বিজ্ঞানবাদী কবিতার দখলে। যা বাঙালি জাতির চেতনার মর্মমূলে জল সিঞ্চন করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
আমাদের হারানো নাগরী লিপির সাহিত্যকে বাংলা লিপ্যান্তর করে গবেষক মোঃ আবদুল মান্নান ও মোস্তফা সেলিম নতুন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করে চলেছেন। শেষোক্ত গবেষকের মালিকানাধীন উৎস প্রকাশন ২৫টি সিলেটি নাগরী লিপির গ্রন্থসম্ভার সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। আরো ২৫টি গ্রন্থ সম্ভার প্রকাশের মিছিলে রয়েছে। রয়েছে একটি নাগরীলিপি যাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা তাদের। শেকড় সন্ধানী এ সকল উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে যে বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন চলছে তাও সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যেরই স্ফুরক। এ কথাটি কৃতিমান সিলেট সন্তান ও গবেষকদের মুল্যায়নে রাখতে হবে।
আমাদের শেকড়ে রয়েছে চর্যাপদ, নাগরী লিপি ও সিলেট নাগরী সাহিত্য। তেমনি বাংলা সাহিত্যের মধ্য আকাশ জুড়ে রয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের আরেক অধ্যায় ইসলামী দর্শন সাহিত্য। যে সাহিত্যকে সমৃদ্ধি দিয়েছেন দার্শনিক দেওয়ান মোঃ আজরফ। লোকসঙ্গীত ও লোকসাহিত্যকে হবিগঞ্জের দিনারপুরের কোরেশী মাগন ঠাকুর (দেওয়ার নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ) ও সুলতানশীর সৈয়দ সুলতান ভিত্তি দিয়েছেন। আর আশরাফ হোসেন সাহিত্য রতœ, চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভূষণ ও চৌধুরী হারুন আকবর লোক সাহিত্যকে দিয়েছেন পূর্ণতা। মরহুম নুরুল হক দেওঘরী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করে সিলেটে সাহিত্য ভান্ডার গড়েছেন। রম্য সাহিত্য পূর্ণতা পেয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর হাত দিয়ে। হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে জনপ্রিয় সিলেট গীতিকা কেবল আবিষ্কারের কারণে ময়মনসিংহ গীতিকা বলে অপ-পরিচিতি পেয়েছে তাও সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
‘সিলেটে মধ্যমা নাস্তি’ খুবই সত্যবাণী, আর সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা ও পূর্ণতা সমৃদ্ধ মানসিকতার পরিচায়ক। যা সিলেটিদের কাছে গৌরব করার বিষয়। তাই দেখা যায় বাংলা সাহিত্যের জন্ম থেকে শুরু করে এর বেড়ে ওঠা সর্বত্রই সিলেট সন্তানদের জয় জয়কার। অথচ আমরা এ কথাটি সাহস করে জোরে বলিনা। কেন যেনো একটি অনিহা আর কোথায় যেন অ™ভুত সংকীর্ণতা বা অজানা লজ্জা ভীতি আমাদেরকে গ্রাস করে রেখেছে। অথচ এই বিষয়টি যত বেশি উচ্চারিত হবে তত আমাদের অহমিকা বাড়বে। চেতনা ফিরে পাবে নতুন প্রজন্ম। সিলেটের সুনাম ও ঐতিহ্যই হবে আমাদের পাথেয়। অর্থবৃত্তের পেছনে বিদেশ বিভূইয়ে ছুটে বেড়ানো আমাদের ঐতিহ্য নয়। তাই আমাদের কাজ সাহিত্যের পথে সিলেটকে সমুন্নত রাখা।