শাহ আলম শামীম, কুলাউড়া থেকে :
এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি তীরবর্তী গরীব ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ এখন বিকল্প জীবিকায়নের প্রতি বেশি আগ্রহী। জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন অবসরে বাঁশ বেত দিয়ে কুটির শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ বানাতে ব্যস্ত। কেউ বাড়ির আঙিনায় আবার কেউবা কম সময়ে সহনশীল ফসল চাষে ব্যস্ত। এর ফলে তাদের জীবিকায়নেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কৃষাণী জোছনা বেগম বিশ্বের ১০ নারীর মধ্যে ৩য় স্থানে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন।
সরেজমিন হাওর এলাকায় গেলে হাওর তীরের দরিদ্র মানুষেরা এই পরিবর্তনের কথাগুলো জানান। হাকালুকি হাওর সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। হাওর তীরের ৫ উপজেলার ২ লক্ষাধিক মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হাওরের উপর নির্ভরশীল। তারা অতিমাত্রায় হাওরের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় হাওরের উদ্ভিদ ও জীববৈত্র্যি যেমন হুমকির মুখে পড়ে, তেমনি অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাদের জীবন জীবিকার। অকাল বন্যা আর দীর্ঘ খরায় প্রতি বছরই ক্ষেতের ফসল হারিয়ে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফলে সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরসহ দেশের ৮টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে। হাওরকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসে। হাওরে মৎস্য অভয়াশ্রম করার পাশাপাশি হাওর তীরের মানুষকে আনা হয়েছে বিকল্প জীবিকায়নের আওতায়। বেসরকারি সংস্থার প্রচেস্টার উদ্যোগে বিকল্প জীবিকায়ন কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে হাওর তীরের হতদরিদ্র ও জেলে পরিবারের ২ হাজার পরিবারকে। ৫০টি সমিতির মাধ্যমে ৮৪৯ জন পুরুষ ও ১১৫১ জন নারীকে নিয়ে মুলত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওর উত্তর তীরের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের রাঙজিউল গ্রামে গেলে অনন্ত বিশ্বাস ও জয়া রানী বিশ্বাস জানান, তাদের গ্রামের শতভাগ মানুষ মৎস্যজীবী। বর্ষা মৌসুমের ৩ মাস তারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শুষ্ক মৌসুমে গুটি কয়েক জেলে বিলের ইজারাদারের মাছ ধরতে যান। বছরের ৯ মাস তাদের বেকার সময় পার করতে হয়। এখন ৩০ জন সদস্য মিলে তারা একটি সমিতি গঠন করেছেন আর প্রচেষ্টা থেকে ৫ হাজার টাকা করে সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে কুটির শিল্পের কাজ করেন। বাঁশ কিনতে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলায়। ৫ হাজার টাকার বাঁশ কিনে তা দিয়ে নিত্য ব্যবহার্য্য টুকরি, মাছের চাঙা, ছাতা, কোলা ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করেন ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকায়। বিক্রি করতেও যেতে হয় পার্শ্ববর্তী আরেক উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জে। এত কষ্টের পরেও তাদের মনে একটু স্বস্তির খবর হলো- সারা বছর তারা কাজ করতে পারেন। গোলাপগঞ্জের পশ্চিমপাড়া, কুলাউড়ার ভুকশিমইল ইউনিয়নের কাড়েরা, দক্ষিণ সাদিপুর, মীরশঙ্কর এলাকার ৩ শতাধিক মৎস্যজীবী পরিবার সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে মাছ ফেরি করে বিক্রি করেন বলে জানান। এছাড়া বরমচাল ও ভাটেরা ইউনিয়নের নারীরা হাসমুরগী পালন, গবাদি পশুপালন, ধাত্রী প্রশিক্ষণ, ঘরের আঙিনায় শস্য উৎপাদন, নার্সারীতে চারা উৎপাদন করেন। তাছাড়া আলু, গম, ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, শসা, বরবটি এবং কমসময়ে উৎপাদিত বোরা ধান চাষ করেন। এসব প্রতিটি ফসলেরই রয়েছে প্রদর্শণী প্লট। আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের জার্নালে ১০ শ্রেষ্ঠ নারী কৃষাণীর তালিকা প্রকাশ করে। হাওর তীরের বরমচাল ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামের কৃষাণী জোছনা বেগম সেই তালিকায় ৩য় অবস্থানে আছেন । রিতা বিশ্বাস, স্বপ্না দাস, দিলারা বেগম, হালিমা বেগম, হেনা বেগম, রুশনা বেগম জানান, নারীদের নেতৃত্বদান করার একটা যোগ্যতাও অর্জন করেন। এখন আমরা প্রতিটি সমিতি প্রতিমাসে নিজেদের মধ্যে সঞ্চয় সংগ্রহ শুরু করেছি। প্রকল্প না থাকলেও যাতে নিজেরা কাজ করতে পারি। সমিতি রেজিস্ট্রেশন করা হবে। বিকল্প জীবিকায়ন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছরের জুনে। তবে হাওরপাড়ের মানুষ মনে করেন, প্রকল্পটি অব্যাহত থাকলে মানুষ বিকল্প জীবিকায়নের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হবে। প্রকল্পের ম্যানেজার ফেরদৌস আলম জানান, হাওর তীরের মানুষকে বিকল্প কর্মসংস্থানে আগ্রহী করার জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সদস্যদের একটা যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে । প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এসব দরিদ্রপীড়িত মানুষের জন্য নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং সৌরবিদ্যুতের প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। হাকালুকি জীবিকায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা প্রচেষ্টার নির্বাহী পরিচালক নবাব আলী নকি খান জানান, আমরা সব সময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। হাকালুকি হাওরটা আমাদের সম্পদ। হাওর পাড়ের দরিদ্রপীড়িত মানুষেরা যদি বিকল্প পেশায় আগ্রহী হয় এবং উপকৃত হয় তাহলে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও বাড়ানো বা চালু রাখার ব্যাপারে দাতাসংস্থা অক্সফামের কাছে প্রস্তাব করবো।