চা বাগানে রঙের উৎসব ফাগুয়া

147

pic-4সাইফুল ইসলাম শ্রীমঙ্গল থেকে :
চা বাগান এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। সেই চির চেনা দৃশ্য, সেই  সজীবতার রং চা-বাগানে আগের মত নেই বললেই চলে। বৃষ্টি প্রধান এলাকা শ্রীমঙ্গল। প্রতিবছর মার্চ মাস থেকেই দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়। গেল ফেব্র“য়ারী মাসে সামন্য বৃষ্টি পাত হলেও মার্চ মাস থেকে বৃষ্টির কোন দেখা নেই। লক্ষ-কোটি চা-গাছ দাঁিড়য়ে  আছে সারি সারি মাঠের পর মাঠ।
বিবর্ণ চা শিল্পাঞ্চলের মানুষগুলোর রংধুনর সাতরং ভর করেছে। তারা মেতে উঠে রঙের উৎসব ফাগুয়ায়।
বেগুনী, নীল, আকাশি, সবুজ ,হলুদ, কমলা লাল -কী নেই? যে দিকে তাকানো যায় সেদিকেই রঙের ছড়াছড়ি। নারী -পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ সব বয়সীরা মেতে ওঠে ফাগুয়া উৎসবে।
একে অপরের দিকে রং ছুড়ে মারছে, গান গাইছে, নাচছে। তরুণ তরুণী, কিশোর-কিশোরী এমনকি ৭০-৭৫ বছরের বৃদ্ধরাও আনন্দ মেতে উঠেন। প্রাণের উচ্ছ্বলতায় বয়সের ভেদাভেদ ভূলে গেছে সবাই।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগান ঘুরে দেখা গেল এমন দৃশ্য। ভাড়াউড়া চা বাগানের কোয়ার্টার লাইনের এক ঘরে সামনে মোটর সাইকেল দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি তাদের এই রঙের খেলা।
মোটর সাইকেল দাঁড়াতেই রঞ্জিত মাঝি নামে এক লোক আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ভয়ে ছিল। এই বুঝি রং মেরে কাপড়-চোপড় নষ্ট করে দিবে। কিন্তু না।  লোকটি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেও ছিনার কোন উপায় ছিল না। সারা শরীরে নানা রঙের আবরণে ঢাকা পড়েছে।
চা জনগোষ্ঠী আধিবাসী ফন্টের সভাপতি পরিমল বাড়াইক জানালেন, বছরে অনেকগুলো উৎসবের মধ্যে অন্যতম দুইটি উৎসব চা-জনগোষ্ঠীর মানুষজন আনন্দের সুযোগ পায়। এক, বাঙালির সনাতন হিন্দু ধর্মের দুর্গাৎসব। দুই, রঙের উৎসব ফাগুয়া। ফাগুয়া প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে আর চৈত্র মাসের প্রথম দিকে পূর্ণিমা তিথিতেএ উৎসব শুরু হয়।
উৎসব উপলক্ষে চা বাগানে দুই দিনের ছুটি দেয়া হয়। চা বাগানে এ উৎসব যে দিন শুরু হয় সেইদিন থেকে আরো ১৫দিন পর্যন্ত তার রেশ থাকে। উৎসব শুরুর আগে থেকে রাতের বেলায় চা-বাগান লাখড়ি সংগ্রহ করে থাকে। তিনি আরো  জানান, ফাগুয়া উৎসব উৎপত্তি ভারত থেকে।  সাধারণত হলি খেলা উৎসব বলে, “ভারতীয় শব্দ”।  ভগবান শয়তানকে ধংস করায় সেই ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রতিবছর এই ফাগুয়া উৎসব করে থাকে।
চা শ্রমিকদের কথা বলে জানা যায়, ছন্দ-তাল লয়হীন এসব চা শ্রমিকের কঠিনতম জীবনে ফাগুয়া উৎসব এসেছে মহান্দরে জোয়ার নিয়ে সেই জোয়ারে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি চা-বাগানের অনাচে-কানাচে। শুধুই রং, শুধুই রঙের ছড়াছড়ি।
ছোপ ছোপ রঙের দাগ লেগেই থাকে চা -বাগানের অলিগলিতে, শ্রমিক লাইন, বাড়িঘরের আঙিনায়। ভাড়াউড়া চা বাগানের মতো প্রতিটি চা-বাগানে তরুণেরা তরুণ-তরুণী সেজে নাচের দল নিয়ে বের হয় শ্রমিক লাইনে। তারা পরিবেশন করেছে চা-বাগানের জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী কাঠিনৃত্য। তাদের পরিবেশনায় বাড়তি আনন্দ জোগাচ্ছে। মাদলের তালের সঙ্গে পাহাড়ি গানের সুর সৃষ্টি করেছে এক রকম আবহ, মাধুর্য। নিজেইর অজান্তেই যেন হারিয়ে যাওয়া যায় এক অন্য রকম শৈল্পিক নেশায়।
মনিরাম সাঁওতাল, লিমন হাজরা, সাধন রিকিয়াশন, বীরবল ঘাটুয়া, সঞ্জিত সাওতাল, লবরি রিকিয়াশন, মাচন সাওতাল, মানিক সাওতাল, হৃদয় সাওতাল, এমপি দূসার, শিবহাল হাজরা, শুভন সাওতাল শ্রমিক-সন্তানদের নাচের দলের এ পরিবেশনা চলে ১৫ দিন পর্যন্ত।
শ্রমিক লাইন ছাড়াও তারা তাদের পরিবেশনায় নিয়ে চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে যাচ্ছে, আবার বাগানের কর্মচারীদের বাড়িতেও নেচে গেয়ে আনন্দ দিয়ে যায়।
নাচের দলের দলনেতা ভুরভুরিয়া চা-বাগানের সুবলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল,ফাগুয়া উৎসব সামনে রেখে দল গঠনের জন্য তারা মাস খানেক আগ থেকে মহড়া দেন। যারা ভালো নাচতে পারে,গাইতে পারে,বাজাতে পারে তাদের নিয়ে দল গঠন করেন। একেকটি চা বাগানে এমন চা বাগানে  দু-তিনটি দল হয়।
তাদের মধ্যে আবারও ভেতরে ভেতরে প্রতিযোগিতাও চলে। ভাড়াউড়া পেরিয়ে ভুরভুরিয়া চা-বাগান পৌছার পরও কানে আসলে পাহাড়ী মাদলের সুর।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউটের পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে গিয়েও চোখে পড়ল এমন দৃশ্য। শিশু -কিশোর, তরুণ – তরুণী, মধ্যবয়সী সবাই নাচছে, গাইছে, আনন্দ করছে। শত দু:খ কষ্ট,শত অভাব অনটনের মধ্যেও উৎসবের তিনটি দিন তারা পরিবার – পরিজন নিয়ে আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করে থাকে। এ আনন্দ ভাগাভাগি করে প্রতিবেশিদের সঙ্গেও। দূর -দূরান্ত চা -বাগানের মেয়েরা নাইওর এসেছে জামাইসহ।
রশিদ পুর  চা বাগান থেকে ভাড়াউড়া  চা -বাগানের বাপের বাড়ি নাইওর এসেছেন  সীমা তাঁতি। শুধু সীমা তাঁতি নন, সীমার মতো প্রতিটি চা-বাগানের ঘরেই এসেছে নাইওরি। প্রত্যেক চা শ্রমিকের বাবা উৎসব উপলক্ষে সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। নতুন কাপড় উপহার দিয়ে থাকেন মেয়ে, জামাই, নাতি,নাতিনিকে।
জামাইরাও দিচ্ছেন শশুড়-শাশুড়ীকে। এটাই নাকি চা-বাগানের শ্রমিকদের শত বছরের প্রথা। চা-বাগানের বাজারগুলোতে দোকানিরা মিঠাই মন্ডা সাজিয়ে বসেছে। তবে দুইটি উৎসবের কটা দিন ভালোই বিকিকিনি চলে। ভাবতে ভালো লাগে, ফাগুয়ার উৎসবে নাইওর এসে সীমার পরিচিত সেই পাহাড়ি ছড়াই অবগাহন করেন, কৈশোরের ফেলে যাওয়া খেলার সাথিদের সঙ্গে প্রাণে প্রাণ মেলান, চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের মগডালে সবুজ ঘুঘুদের ডানা ঝাপটানোর মতোই উচ্ছলতায় মেতে ওঠেন।
সারা দিনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর চা-শ্রমিকেরা যে পারিশ্রমিক পায় তা দিয়ে পরিবারের সবার মুখে দুমুঠো ভাত কিংবা দুটো রুটি দুবেলা তুলে দেওয়াই যেখানে কষ্টকর, সেখানেও এই দু:সহ সীমাবৃদ্ধ জীবনের আঙিনায় আনন্দের ছোঁয়া লাগে, রংধুনু সাতরং উঁকি দেয় অন্তত বছরের এই কয়েকটা দিনে।