কাজিরবাজার ডেস্ক :
রক্তঝরা একাত্তরের ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালির। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু শ্লোগানে কেঁপে উঠে বাংলার আকাশ। নড়ে উঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই যে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল তা নিজের লেখায় স্বীকার করে গেছেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক, পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের লেখা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘… ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সবার মনে একটি চিন্তাই ঘুরপাক খেয়ে ফিরছিল কি করা যায়? কি করবো? … এরপর এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বললেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বান বলেই মনে করলেন।’ শুধু জিয়াউর রহমানই নয়, গোটা বাঙালি জাতিই ৭ মার্চের ভাষণ বুঝে গেলেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণেই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। একাত্তরের ঐতিহাসিক এই দিনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার লগ্নে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানায়।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারপত্রে আহ্বান জানানো হয়, Ñ‘আঘাত হানো, সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো, জনতার স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম করো।’ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মুজাফফর) পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্য ১৭ দফা প্রস্তাব দেয়। এতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা হয়।
৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের শহর। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ Ñশ্লোগানে ঢাকা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কখন ঘটবে বিস্ফোরণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে সারাশহরে। শেখ মুজিব নিজ মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ দেননি হানাদারদের। টানটান উত্তেজনার মধ্যে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় এই জনসভা।
দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেন। সাথে সাথে শুরু হয় মুহুর্মুহু করতালি। বঙ্গবন্ধু সাবলীল ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে ওঠেন। মুহূর্তে সবকিছু থেমে যায়। পিন পতন নীরবতা। দাঁড়িয়েই তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় বজ্রকণ্ঠে বক্তব্য শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু। ভাইয়েরা আমার। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সম্মুখে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। তিনি বলেন, দেশে কি হচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সারাদেশে আমার লোকদের হত্যা করছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি আজ এখানে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, অবিলম্বে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। তিনি যদি হুকুম দিতে নাও পারেন, এমনকি তাঁর অনুপস্থিতিতে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবেÑ এই নির্দেশনাই দেন সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণে। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই জনগণ পাগলের মতো সমাবেশস্থল ত্যাগ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্য ছিল দীর্ঘ ১৮ মিনিটের। অথচ তাঁর বক্তব্যে ছিল সমগ্র জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য। সবকিছুই ছিল এতে। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যকে আখ্যা দিয়েছেন গেটিসবার্গ এড্রেসের সাথে। কেউ কেউ তুলনা করেছেন চার্চিলের অশ্র“সজল নয়নে দেয়া বক্তব্যের সাথে। তাঁর এ বক্তব্য জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির পথ দেখিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু জানতে পেরেছেন, রেডিও তাঁর বক্তব্য সম্প্রচার করছে না। তিনি বিস্মিত হন। তিনি ভাষণের একপর্যায়ে বলেন, আমি এইমাত্র জানতে পেরেছি, আমার বক্তব্য রেডিও সম্প্রচার করছে না। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে রেডিওতে কাজ বন্ধ করে দিতে বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান। সাথে সাথে রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দুটি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এর সূত্র ধরেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিপাগল বাঙালিরা ছিনিয়ে আনে মহামূল্যবান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ আজ ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকাল ৩টায় ৭ মার্চের ভাষণের স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন। আওয়ামী লীগের সব শাখা কমিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণ করবে।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।